বাংলা মহাকাব্য সম্পর্কিত প্রবন্ধ রচনা

অনুচ্ছেদ সমূহ
বাংলা মহাকাব্য হল একটি বিশাল কবিতার সমাহার যা সাধারণত শ্রীমদ্ভাগবত, রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি মহাকাব্যের মতো। এই কাব্যগুলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম সহ অনেকগুলো কবির কাজের ফল। এই কাব্যগুলো আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অপূর্ব অংশ হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
বাংলা মহাকাব্য
ভূমিকা :
পাশ্চাত্য ‘এপিক’ কথাটির সৃষ্টিমূলে আছে প্রাচ্যের ন্যায় ‘বৃত্ত’ বা ‘ব্যাপার’ জিনিসটি। ‘ইপস্’ শব্দের অর্থ গল্প। অতএব ‘এপিক’ অর্থাৎ মহাকাব্য বললে গল্প সম্পর্কিত কোন কিছুকেই নির্দেশ করা হয়। তা হলে বলা চলে, যে উপাখ্যানটিকে গাম্ভীর্যময় পরিবেশে সুবিন্যস্ত করে গল্প বলা হয় তার নাম ‘এপিক’। বীররস ছাড়া নীতি ও ধর্মের আদর্শও এতে প্রচুর মেলে। অনন্ত আসমান, দিগন্ত বিসার শূন্য আর অপরিমেয় ব্যোম-এ হলো মহাকাব্য কল্পনার রঙ্গক্ষেত্র। পাশ্চাত্য মহাকাব্যের উপাদান প্রধানত তিনটি। ভাবধারা, শব্দ সম্পদ এবং শব্দের বাঁধুনি— এগুলো এপিকের পক্ষে অপরিহার্য।
গ্রাণের সুষমা, শক্তি ও মাধুর্য—এ সব যাতে ফুটে উঠতে পারে এমন দেহ হবে মহাকাব্যের । এই তিনটির দিকে যদি নজর থাকে তাহলে চরিত্র-চিত্রণ, প্রকৃতি বর্ণন, যুদ্ধ-বর্ণন প্রভৃতি তো আপনা থেকেই সুর বাঁধা হয়ে সমুন্নতরূপে প্রকাশ পায়।
মহাকাব্যের লক্ষণ :
‘মহাকাব্য’ উচ্চারণ করার সংগে সংগে আমাদের মনে পড়ে বিশাল ব্যাপক এক বিরাট কাব্য যে আমাদের স্তম্ভিত ও আশ্চর্য করে দেবে। সত্যিই এ ধারণায় কোন ভুল নাই। মহাকাব্য — কাব্য বটে; কিন্তু তা’ বিরাট। মহাকাব্যের চিন্তার কাল স্বর্গ-মর্ত্য পাতালপ্রসারী। এর নায়ক হবেন ধীরোদাত্ত, ধীরপ্রশান্ত সদ্বংশের সন্তান। গুরুগম্ভীর ওজস্বিনী ভাষায় মহাকাব্য রচিত হবে। নয়টি রসের যে-কোন একটির অবতারণা করতে হবে। অষ্টাধিক সর্গে রচিত হবে। এমনিধারা অনেক বিধিনিষেধ মেনে নিয়ে জাতীয় জীবনের ঐতিহ্য গৌরবান্বিত ঘটনার বর্ণনা দিয়ে যে কাব্য রচিত হয়, তা’ মহাকাব্য নামে অভিহিত।
দুই শ্রেণীর মহাকাব্য:
যুগ পরিবর্তনের সংগে সংগে ‘এপিক’ অর্থাৎ মহাকাব্যের আকৃতি-প্রকৃতিরও রূপান্তর হয়। এক শ্রেণীর মহাকাব্য কবি বিশেষের কোন প্রাণ স্পন্দনই শোনা যায় না। যেন মনে হয় স্রষ্টা নিরপেক্ষ সৃষ্টি—মনে হয় অনেক অজ্ঞাতনামা প্রতিভাধর কবির মিলিত প্রয়াস এতে রূপায়িত। এই ধরনের মাহাকাব্যকে ইংরেজীতে বলা হয় Epic of Growth অথবা Authentic Epic – জাত মহাকাব্য। এতে একটা সমগ্র জাতির অখণ্ড প্রাণসত্তা ফুটে উঠে। রামায়ণ, মহাভারত, অডিসি, ইলিয়ড প্রভৃতি এই ধারার উদাহরণ।
আর এক শ্রেণীর মহাকাব্য ‘Epic of Art’ বা ‘Literary Epic’ শিল্পাত্বাক মহাকাব্য-এর আয়তন পূর্ববর্তী মহাকাব্যের মত বিরাট না হলেও ঘটনা পারম্পর্য ও মাধুর্যে মহীয়ান, এই ধারার সৃষ্টিকে ‘A work of deliberate Art’ বলা যায়। ‘Paradise Lost’. এনিড, বৃত্রসংহার, মেঘনাদবধ প্রভৃতি এই শ্রেণীর মহাকাব্যের উদাহরণ। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মহাকাব্যের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় উনিশ শতকে। রঙ্গলাল থেকে আরম্ভ করে কায়কোবাদের সময় পর্যন্ত ‘মহাকাব্যের যুগ’ নামে অভিহিত করা যেতে পারে।
রঙ্গলাল ‘পদ্মিনীর উপাখ্যান’ নামে একটি মাহকাব্য রচনা করেন। দিল্লীর সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী ও চিতোরের রাণী পদ্মিনীর কল্পিত কাহিনী অবলম্বনে এটা লিখিত। কবির কৃতিত্ব এখানে যে, তিনি দেবদেবী, পুরাণের গালগল্প প্রভৃতি বিষয় নিয়ে মহাকাব্য রচনা করেননি, বরং জাতীয় মর্যাদা ও স্বাজাত্যাভিমানের ধারক একটি বলিষ্ঠ ঐতিহ্যকে কাব্যে রূপ দিয়েছেন। মহাকাব্য হিসাবে পদ্মিনীর উপাখ্যান’ সার্থক সৃষ্টি নয়। পদ্মিনীর রোমান্টিক প্রণয়, সতীত্বের আদর্শ পারিবারিক জীবনের বেদীমূলে ব্যক্তিগত জীবন উপহার মহাকাব্যের সার্থকতার পথে বাধা সৃষ্টি করেছে।
মধুসূদনের মহাকাব্য :
মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। দেশী-বিদেশী প্রমুখ কবিদের নিকট থেকে উপাদান নিয়ে তিনি এই অপরূপ কাব্য রচনা করেন। রাম-লক্ষণের সঙ্গে রাবণ-মেঘনাদের যুদ্ধ-কাহিনীই এর বিষয়বস্তু। সীতা অপহরণের জন্য উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ হয়। এটা আদি রামায়ণে রয়েছে, তার সঙ্গে মধুসূদনের মিল নেই। রাবণ জানে না তার কি অপরাধ । সে জানে রাম আক্রমণকারী, স্বাধীনতা হরণকারী—তার হাত থেকে স্বাধীনতা—সূর্য অটুট রাখার জন্য যুদ্ধ করতে হবে। রাবণমেঘনাদ অসাধারণ শৌর্য-বীর্যের সঙ্গে এখানে চিত্রিত হয়েছে, রাম-লক্ষণ চরিত্র কিছুটা হীনতার সঙ্গে রূপায়িত হয়েছে। দৃষ্টিভঙ্গির এই প্রখর চেতনার জন্য মধুসূদনের পক্ষে সম্ভবপর হয়েছিল একটি নতুন কাব্য সৃষ্টি করা। উপরোক্ত এ কাব্যে মধুসূদন তাঁর যুগের মানসিক উৎকণ্ঠা, আশা-আকাঙ্ক্ষা ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন।
মহাকাব্যের ভাব-গাম্ভীর্য অটুট রাখার জন্য কবি উপমা উৎপ্রেক্ষার ত্রুটি রাখেননি। ভাষা ও শব্দ ব্যবহারে তিনি ধ্বনি-তরঙ্গ সৃষ্টি করতে পেরেছেন।
কল্পনা, বিস্তৃতি ও বিশালতা, ধ্বনিতরঙ্গ ও ভাব গাম্ভীর্যে মেঘনাদবধ কাব্যের তুলনা নেই বাংলা সাহিত্যে। হেমচন্দ্র ‘বৃত্রসংহার’ রচনা করে প্রচুর খ্যাতির অধিকারী হয়েছিলেন। মহাভারতের অন্তর্গত বন-পর্বে বিধৃত ইন্দ্র কর্তৃক বৃত্রবধের কাহিনীই ‘বৃত্রসংহারের’ বিষয়বস্তু। মহাকাব্য হিসাবে এর সার্থকতা নেই বললেই চলে। সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্র অনুসরণ করে, হেমচন্দ্র এই কাব্য লিখলেও যথার্থ মহাকাব্য রচনা করতে ব্যর্থমনোরথ হয়েছেন। ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ কল্পনার যে বিশালতা, গাম্ভীর্য ও ধ্বনি-তরঙ্গ দেখি, ‘বৃত্রসংহারে’ তার খুব অভাব রয়েছে। [ বাংলা মহাকাব্য, বাংলা মহাকাব্য কী? বাংলা মহাকাব্য কাহাকে বলে? বিখ্যাত্য বাংলা মহাকাব্য, বিখ্যাত্য বাংলা মহাকাব্য এর নাম? ]
অন্যদের মহাকাব্য:
নবীনচন্দ্র সেন যে-মহাকাব্য রচনা করেন তার নাম ‘রৈবতক, কুরুক্ষেত্র, প্রভাস’। একসঙ্গে একে ‘ত্রয়ীকাব্য’ বলা হয়। হিন্দু ধর্ম ও জাতির পুনরুত্থান কবি কামনা করেছেন। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন যে, কৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটছে এ পৃথিবীতে। তিনি নানাভাবে পীড়িত মানুষকে রক্ষা করবেন। কাজেই জাতীয়তার সংকীর্ণ আদর্শই নবীনচন্দ্রের লক্ষ্য ছিল, বলতে পারা যায়। অবশ্য মহাকাব্যের একটা বিস্তৃত পরিধি এতে রয়েছে। শব্দ ব্যবহার ও উপমা রূপকে নবীনচন্দ্র সার্থকতা অর্জন করতে পারেননি। লক্ষণীয় যে, রবীন্দ্রনাথ, কোন মহাকাব্য রচনা করেননি। কিন্তু মহাকাব্য রচনা অব্যাহত রইলো। মধু-হেম নবীনকে অনুসরণ করে অনেকগুলি মহাকাব্য রচিত হলো।
কায়কোবাদের ‘মহাশ্মশান’ একটি উল্লেখযোগ্য মহাকাব্য হিসাবে গণ্য। যদিও মহাকাব্যের সংজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে এটাকে মহাকাব্য পদবাচ্য করা যায় কিনা সন্দেহের বিষয়। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ নিয়ে এটি রচিত। ৮৭০ পৃষ্ঠাব্যাপী এই বিপুলায়তন কাব্যে কবি হিন্দু-মুসলমানদের জাতীয় জীবনের একটি কাহিনীর রূপদান করেছেন। অন্যান্য মহাকাব্য থেকে এর তফাত হচ্ছে এই যে, কবি এখানে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাব্য রচনা করেননি। তবে মহাকাব্য হিসাবে এর বিশেষ সার্থকতা নেই। মহাকাব্যের মধ্যে যে বিশালতা, ভাব-গাম্ভীর্য, উদাত্ত ধ্বনি তরঙ্গ লক্ষ্য করি, এখানে তার বিশেষ অভাব আছে। ইহাছাড়া, যোগীন্দ্রনাথ বসুর ‘পৃথ্বীরাজ’ ও ‘শিবাজী’ নামে দু’টি মহাকাব্য আছে। মহাকাব্য হিসাবে লিখে তিনি কম বেশি সার্থকতা অর্জন করেছেন। তবু তিনি মহাকাব্যকার হিসাবে পাঠকের কাছে অপরিচিত হয়ে রয়েছেন। কবি মানকুমারী বসুর ‘বীর কুমার বধ কাব্য’ নামক মহাকাব্য রচিত হয় ১৩১০ সালে। ৯টি সর্গে রচিত হয় ২৩৫ পৃষ্ঠার এই রচনা। রচনাটি উল্লেখযোগ্য, তবে এরও প্রচার নাই।
উপসংহার:
সত্যি কথা বলতে কি, মহাকাব্য রচনার মন ও মেজাজ বাঙালী কবিদের নেই। যে গীতিবহুল বৈশিষ্ট্য এদের গীতি-কবিতার পক্ষে সহায়ক হয়েছে। তা’ মহাকাব্য রচনার ক্ষেত্রে বাধাস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাজেই মহাকার্য রচনা করলেও তা হয় গীতি-মাধুর্যে প্লাবিত হয়েছে, নয়তো মহাকাব্যের বিশালতা, ব্যাপকতা ও বিস্তৃতি লাভ করেননি। সেইজন্য ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’, ‘ইলিয়ড’, ‘ওডেসি’র মত সার্থক ও যথার্থ মহাকাব্য লাভ করার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি।
[ বাংলা মহাকাব্য, বাংলা মহাকাব্য কী? বাংলা মহাকাব্য কাহাকে বলে? বিখ্যাত্য বাংলা মহাকাব্য, বিখ্যাত্য বাংলা মহাকাব্য এর নাম? ]