প্রবন্ধ রচনা

হযরত মুহম্মদ (সাঃ) প্রবন্ধ রচনা

হযরত মুহম্মদ (সা.) ( হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক ও নবী। ইসলাম ধর্মে হযরত মুহম্মদ (সা.) বিশ্বব্যাপী মুসলিম জাতির সর্বপ্রথম নবী হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি 570 খ্রিস্টাব্দে আরবের মক্কা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি স্বদেশে বড় পরিবর্তন ঘটে দিলেন এবং ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হিসাবে দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে ধর্মীয় উন্নয়ন করেন। তিনি কুরআন শরীফের প্রথম সূত্র অবহেলন করেন এবং কুরআন শরীফের প্রতি মুসলমানের মর্যাদা রাখতে উপদেশ দেন। হযরত মুহম্মদ (সা.) একজন মহান শিক্ষক, সামাজিক সংগঠক এবং রাষ্ট্রনির্মাতা হিসাবে স্মরণীয়।

হযরত মুহম্মদ (সাঃ)

ভূমিকা : যুগে যুগে পৃথিবীর মানুষের মন ভুল-ভ্রান্তি, অজ্ঞতা ও কুসংস্কারে যখন পূর্ণ হয়, সনাতন আদর্শ ও সত্যসুন্দর তুলে সে যখন পাপের কালিমার মধ্যে আচ্ছন্ন হয়, তখনই একজন মহাপুরুষ আবির্ভূত হয়ে পথভ্রষ্ট মানুষকে সত্যের পথে, ন্যায়ের পথে চলার জন্য পথ নির্দেশ করেন। মরুর দুলাল হযরত মুহম্মদ (সাঃ) এমন একজন মহাপুরুষ। তিনি আরব জাতির মধ্যে এমন এক সময়ে আবির্ভূত হন, যখন তাদের জাতীয় আদর্শ একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাই বলে তিনি শুধু আরবের নন, সমগ্র পৃথিবীর মানুষের কাছে ইসলামের আদর্শ এবং মহিমা প্রচার করেছিলেন, তাঁর পূত স্পর্শে বিশ্ব ধন্য হয়েছে। সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার বাণী বিশ্বের দ্বারে বহন করে মুসলমান তাঁর প্রিয় নবীর জীবনসাধনাকে সার্থক করে তুলেছে। তিনি সত্য দ্রষ্টা মহামানবই শুধু নন, তিনি আদর্শ কর্মবীর। জগতের ইতিহাসে তিনি অতুলনীয় ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

হযরতের (সাঃ) আবির্ভাবকালে আরবের অবস্থা : হযরত মুহম্মদের আবির্ভাবকালে আরবের সর্বত্র অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা ও অজ্ঞানতা বিরাজমান ছিল। আরবেরা অসংখ্য গোত্রে বিভক্ত ছিল। গোত্রে গোত্রে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম সর্বদা লেগে থাকত। সমাজে নারীর স্থান ছিল অতি নিম্নে। অস্থাবর সম্পত্তির ন্যায় আরবের নারীরা হস্তান্তরিত হত। পুরুষ ও নারীর মধ্যে কোনও পবিত্র বন্ধন ছিল না। ব্যতিচার, মদ্যপান, জুয়া খেলা, দস্যুবৃত্তি, নরহত্যা প্রভৃতি অমানুষিক আচার অনুষ্ঠানই আরবদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। একেশ্বরবাদের আদি উপাসনার গৃহ কারায় ৩৬০টি দেব-দেবীর মূর্তি ছিল। প্রত্যেক গোত্রেরই এক বা একাধিক মূর্তি নির্দিষ্ট ছিল। তারা চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্রাদিরও পূজা করত। তারা পরকাল বিশ্বাস থাক্ত না।

হযরত মুহম্মদ জন্ম ও বংশ পরিচয় : আরব দেশের মক্কা নগরীতে ৫৭০ খ্রীস্টাব্দে রুবেল দুলাল হযরত মুহম্মদ (সাঃ) কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্ব পুরুষ হযরত ইব্রাহিম (আঃ)। হযরতের (সাঃ) পিতার নাম আবদুল্লাহ, মাতার নাম আমেনা খাতুন। হযরতের (সাঃ) জন্মের ছয় মাস আগে তাঁর পিতা পরলোক গমন করেন এবং জন্মের ছয় বছর পর তাঁর মাতার মৃত্যু হয়। প্রথমে বৃদ্ধ পিতামহ আবদুল মুত্তালিবের স্নেহচ্ছাযায় ও তাঁর মৃত্যুর পরে পিতৃব্য আবুতালিবের যত্নে তিনি লালিত-পালিত হন।

হযরত মুহম্মদ বাল্যজীবন ঃ দুঃখের ভিতর দিয়ে হযরতের (সাঃ) বাল্যজীবন অতিবাহিত হয়। জন্মের আগে পিতা এবং জন্মের পরে মাতা মৃত্যুমুখে পতিত হন। কাজেই তিনি বাল্যকাল থেকেই মাতাপিতার স্নেহ-যত্ন থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। অল্প বয়স থেকে হযরতকে (সাঃ) কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। তাঁর পিতৃব্য আবুতালিব বাণিজ্য করতেন, কিন্তু তাঁর অবস্থা সচ্ছল ছিল না, ফলে হযরত (সাঃ) তাঁকে ব্যবসাকার্যে সাহায্য করতেন। তিনি নিজে বাল্যকালে দুঃখ পেয়ে মানুষ হয়েছিলেন বলেই পরবর্তীকালে সমগ্র মানুষের দুঃখ যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পেড়েছিলেন। বাল্যকাল থেকে হযরত (সাঃ) চিন্তাশীল, পরোপকারী ও সত্যবাদী ছিলেন। তাঁর সত্যবাদিতার জন্য লোকে তাঁকে ‘আল আমীন’ বা ‘বিশ্বাসী’ উপাধি প্রদান করে।

দারপরিগ্রহ : হযরতের (সাঃ) বয়স যখন ২৫ বছর, তখন বিবি খাদিজা (রাঃ) নাম্নী মক্কার এক ধনবতী মহিলার প্রতিনিধি হিসাবে সিরিয়া প্রভৃতি দেশে বাণিজ্যে গমন করেন। এই বিধবা মহিলা হযরতের (সাঃ) গুণ ও সত্যবাদিতায় মুগ্ধ হইয়া তাঁহাকে বিবাহ করেছিলেন প্রস্তাব দিলে হযরত (সাঃ) তাঁকে বিবাহ করেন। এই সময় হযরতের বয়স ছিল মাত্র ২৫ বছর এবং হযরত খাদিজার (রাঃ) ২৫ বছর।

নবুয়ত প্রাপ্তি ঃ বাল্যকাল থেকে হযরত (সাঃ) অতিশয় চিন্তাশীল ছিলেন। বিবাহের পর তিনি ধর্মচিন্তায় অধিকতর আকৃষ্ট হন। চারিদিকের পাপাচার ও নাস্তিকতা দূর করাই তাঁর চিন্তার বিষয়বস্তু হয়ে পড়ল। মক্কার অদূরবর্তী হেরা পর্বতের নির্জন গুহায় তিনি দীর্ঘ পনের বছর কাল বিশ্বস্রষ্টার খ্যানে নিমগ্ন থাকেন।

৬১১ খ্রীষ্টাব্দে ৪০ বছর বয়সে তিনি ধ্যানমগ্ন অবস্থায় স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের (আঃ) কাছে থেকে ঐশী বাণী লাভ করলেন। এইরূপে পবিত্র কুরআন শরীফ পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়।

ধর্ম প্রচার : নূরনবী হযরত মুহম্মদ (সাঃ) ‘আল্লাহতা খালার বাণী প্রচারের জন্য প্রেরিত হয়েছিল। ‘তোমরা মূর্তি পূজা ত্যাগ করে নিরাকার আল্লাহতা যালাকে সেজদা কর। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ‘এক আল্লাহ ভিন্ন আর কোন উপাস্য নেই, মুহম্মদ আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ’। এই মহাসত্য প্রচারের জন্য তাঁর উপর সীমাহীন নির্যাতন চলতে লাগল। কিন্তু তিনি দুঃখ কষ্ট ও বাধা বিঘ্নের কাছে কোন নতি স্বীকার করেন নেই। আল্লাহর উপর সম্পূর্ণ ভরসা করে তিনি সমস্ত বিপদের মধ্যে নির্ভীকচিত্তে দাঁড়ালেন। তিনি বললেন, “কুরাইশদের যদি আমার ডান হাতে সূর্য আর বাম হাতে চন্দ্র এনে দেয় তবুও আমি সত্য প্রচারে বিরত হব না। হয় সত্যের প্রতিষ্ঠা করব, না হয় প্রাণ দিব।” এই ছিল হযরতের (সাঃ) সংকল্প।

হিযরত : হযরতের (সাঃ) নতুন ধর্ম প্রচারের ফলে ও মূর্তি পূজার বিরোধিতার দরুন মক্কায় কুরাইশদের তাঁর উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। তারা হযরতকে (সাঃ) প্রাণে বধ করার সুযোগ খুঁজতে লাগল, হযরত (সাঃ) তখন মক্কায় অবস্থান করা নিরাপদ বলে মনে করলেন না। তিনি স্বীয় সহচর হযরত আবুবকর (রাঃ) সহ ৬২২ খ্রীস্টাব্দে মদিনায় প্রস্থান করেন। মদিনার অধিবাসিদের তাঁকে সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়ে গ্রহণ করলাম । ওখানকার ইহুদিদের ছাড়া প্রায় সব লোকই ইসলামে দীক্ষিত হল। চতুর্দিকে বিশ্বাসী ও ভক্ত মুসলমানদের মধ্যে থেকে হযরত (সাঃ) ধর্মপ্রচার ও গঠনমূলক কাজ আরম্ভ করেন। মুসলমানদের প্রার্থনার জন্য মদিনায় কাঁচা ইটের গাঁথুনি ও খেজুর পাতার ছাউনি দিয়ে মসজিদ নির্মিত হল। এই মসজিদে বসে হযরত (সাঃ) প্রথম মুসলিম রাজ্যের শাসনকার্য সম্পন্ন করতেন এবং একে কেন্দ্র করেই ইসলাম জগৎ গড়ে উঠল।

মক্কা বিজয় : ৬২৮ খ্রীস্টাব্দের শেষভাগে হযরত (সাঃ) মক্কায় হজ্ব গমন করলে কুরাইশগণের সঙ্গে ‘হোদাইবিয়া’ নামক স্থানে সন্ধি হয়। কিন্তু তারা এই সন্ধিশর্ত ভঙ্গ করলে ৬৩০ খ্রীস্টাব্দে হযরত (সাঃ) দশ হাজার মুজাহিদসহ মক্কা জয়ের জন্য অগ্রসর হলেন। মক্কার বীর যোদ্ধারা একে একে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায় কুরাইশগণ তখন হীনবল হয়ে পরেছিল। হযরতকে (সাঃ) বাধা দেওয়ার কোন শক্তিই তাদের ছিল না। হযরত (সাঃ) তাঁর অপূর্ব ধৈর্য, দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা ও বিশ্বাসের ফলে বিনা রক্তপাতে মক্কা জয় করেন। দলে দলে লোক ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করল। সমগ্র আরব ইসলামের ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হল। ৬৩২ খ্রীস্টাব্দে হযরত মুহম্মদ (সাঃ) এলোক ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ৬৩ বছর হয়েছিল।

হযরত (সাঃ)-এর চরিত্র : “হযরতের (সাঃ) মধ্যে তোমরা (জীবন-যাত্রার আদর্শের একটি সুন্দর উদাহরণ পাবে।” পবিত্র কুরআনের এই বাণীর মধ্যেই হযরতের (সাঃ) চরিত্র-মাধুর্যের মর্মকথা নিহিত আছে। বিশ্বস্ততা, ন্যায়পরায়ণতা, সহিষ্ণুতা, ধৈর্যশীলতা ও সত্যপ্রিয়তা প্রভৃতি মহৎ গুণাবলী তাঁর চরিত্রকে মাধুর্যমণ্ডিত করেছে। এই সত্যের প্রতি অবিচল নিষ্ঠাই তাঁর জীবনকে সার্থক ও সুন্দর করেছে। তিনি ছিলেন স্নেহময় পিতা, প্রেমময় স্বামী, সদাশয় প্রভু ও অসীম দয়ার আধার। আপন-পর, শত্রু-মিত্র সকলের জন্যই তাঁর অবারিত করুণা সমভাবে বর্ষিত হত। প্রাণঘাতী শত্রুকেও তিনি হাতে পেয়ে ক্ষমা করেছেন, তাঁর মহত্ত্ব, চরিত্রবল ও উদার ব্যবহার শত্রুদেরকে পর্যন্ত মুগ্ধ করত। দারিদ্র্যই তাঁর গৌরব এবং দারিদ্র্যের সেবাই তাঁর জীবনের ব্রত ছিল।

হযরতের (সাঃ) চরিত্রের মহত্ত্ব, উদারতা এবং পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে সংযম ও কর্মনিপুণতা দেখে লোকে তাঁকে ফেরেস্তা বলে ধারণা করলে তিনি বললেন, “আমি তোমাদের মতই মানুষ, আমি আল্লাহ্ তা’লার দূত ও দাস, আমি দেবতা বা অবতার নই।” এই বাণী মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ জয় ঘোষণা করেছে। এ ধর্মের ইতিহাসে অভিনব এবং মানবতার ইতিহাসে যুগান্তর এনেছে।

লেখা পাঠিয়েছে – রুপ্সানা আকতার রুমি, বাংলাদেশ

এগুলিও পড়তে পারেন -

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button