একটি বট গাছ এর আত্মকাহিনী । বট গাছের আত্মকাহিনী
একটি বট গাছের আত্মকাহিনী প্রবন্ধ রচনা

বট তথা বট গাছ (Banyan), (বৈজ্ঞানিক নাম : Ficus benghalensis) ফাইকাস বা (ডুমুর জাতীয়) গোত্রের ইউরোস্টিগ্মা উপগোত্রের সদস্য। এর আদি নিবাস হল বঙ্গভূমি (বাংলাভাষী অঞ্চল)। এটি একটি বৃহদাকার বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ। নিম্নে একটি বট গাছ এর আত্মকাহিনী এর রচনা শেয়ার করা হল।
একটি বট গাছ এর আত্মকাহিনী
আমার স্থবির অলস জীবন জগতের কোন কাজে লাগে বলিয়া মনে হয় না; কিন্তু তবু যে মানুষ কেন আমাকে স্মরণ করে বলিতে পারি না। মানুষের সঙ্গে আমার তো কোন সাদৃশ্য নাই।
কখন কোথায় এবং কিভাবে আমার জন্ম হইয়াছে তাহা ঠিক বলিতে পারি না, তবে শিশু বয়সে আমার জন্যভূমির যে রূপ দেখিয়াছিলাম, বর্তমান রূপের সঙ্গে তাহার তো কোন সাদৃশ্য নাই। আমি যে স্থানে জন্মিয়াছিলাম, তাহা ছিল জন-মানব ও জীবজন্তুর অস্তিত্বহীন কর্দমাক্ত এক টুকরা পতিত জমি। আমার আশেপাশে আরও দুই-চারিজনকে দণ্ডায়মান দেখিয়াছিলাম। কিন্তু তাহারা আমার স্বশ্রেণীভুক্ত হইলেও ঠিক স্বজাতি ছিল না। পণ্ডিতেরা বলেন-জাতিতে আমরা না-কি বৃক্ষ এবং আমার পূর্বপুরুষ না-কি শৈবাল-জাতীয় জলজ উদ্ভিদ।
অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে আমাদের বড় ব্যবধান। অন্যান্য প্রাণী চলিতে পারে, আমরা পারি না। আমরা স্থবির। কিন্তু তাই বলিয়া যে আমরা অলস জীবন-যাপন করি, তাহা নয়। মানুষের যেমন আহার-নিদ্রা আছে, তেমনি আমাদেরও আহার নিদ্রা আছে। মানুষের মধ্যে বংশ বিস্তার হইয়া থাকে, আমাদেরও তদ্রুপ। আমাদের বংশ বিস্তারে, প্রধান সহায়ক পাখি। ক্ষুধার্ত হইয়া পাখিরা আমার শাখায় আশ্রয় গ্রহণ করে। আতিথ্য প্রদর্শনে আমিও পশ্চাদপদ হই না। আমার সামান্য ফল, সুশীতল ছায়া দিয়া তাহাদের সেবা করি। কিছু ফল তাহারা গাছে বসিয়া আহার করে, কিছু ঠোঁটে করিয়া লইয়া যায়। কিন্তু এই ফল যেখানে পড়ে সেখানেই আমার সন্তান জন্মগ্রহণ করে। এমন কি পাকা স্থান বা পাথরের উপর পড়িলেও তাহা নিষ্ফল হয় না।
কর্মে আমি মানুষের সমকক্ষ। আমার প্রথম এবং প্রধান কাজ পরার্থপরতা। আমার যে সুশীতল ছায়া আছে তাহা আমার নিজের বিশেষ কোন কাজে না। লাগিলেও মানুষ এবং জীবজন্তুর উপকারে আসে। আমি আমার প্রশান্ত ছায়া বিস্তার করিয়া কত মুনি-ঋষিদের আশ্রয় দিয়াছি। আমার আশ্রয়ে বসিয়া তাঁহারা যে জ্ঞান অর্জন করিয়াছিলেন, আজিকার মণিমাণিক্য খচিত অট্টালিকায় বসিয়া সে জ্ঞান তোমরা অর্জন করিতে পারিবে না। জীবের দুঃখ দূর করিবার পন্থা আবিষ্কার করিতে বুদ্ধদেব যে সাধনা করিয়াছিলেন, তাহা আমারই স্বজাতীয় একজনের ছায়ায় বসিয়া। তোমাদের পূর্বপুরুষ আর্যদের সভ্যতা গড়িয়া উঠিয়াছিল তো আমাদের সাহায্যেই। পথশ্রান্ত তাপতপ্ত ঘর্মাক্ত পথিক যখন আসিয়া আমার আশ্রয় প্রার্থনা করে, আমি তখন সাদরে তাহাকে অভ্যর্থনা করিয়াই লই। ছায়াতলে সমীরণ আসিয়া তাহার ঘর্ম মুছাইয়া ক্লান্তি দূর করিয়া দেয়। শুধু মানুষই নয়, পশু-পক্ষী, জীব-জন্তু সকলেই কিছু কিছু পরিমাণে আমার সহায়তা পাইয়া থাকে। মানুষ যদি আমার আদর্শ গ্রহণ করিতে পারিত তাহা হইলে পৃথিবী শান্তির নীড় হইয়া উঠিত। মনীষীরা আমাদের অমর করিয়া রাখিয়াছেন।
কিন্তু মানুষ দিনদিনই ভয়ানক স্বার্থপর ও অকৃতজ্ঞ হইয়া উঠিতেছে, আর এইজন্য তাহারা শান্তিও খুঁজিয়া পাইতেছে না। তাহারা আজ বুঝিয়াও বুঝিতে চায় না যে, তাঁহাদের পূর্বপুরুষ আমাদের কাছে কত উপকার পাইয়াছেন। তাই আজ *একধার হইতে তাহারা আমাদের হত্যাকার্য সাধন করিতেছে, আর সেই স্থানে গড়িয়া তুলিতেছে বড় বড় অট্টালিকা। আমরা যে নির্দোষ এবং অসহায়, আমাদের দ্বারা তাহাদের উপকার ছাড়া যে অপকার মোটেই হয় নাই, ইহা তাহারা একবার ভাবিয়াও দেখিতে চায় না। গত কয়েক শতাব্দী ধরিয়া আমি মানুষের এই অত্যাচার লক্ষ্য করিয়া আসিতেছি। আমার স্বজাতীয়দের অনেকেই ইতিমধ্যে তাহাদের হাতে প্ৰাণ দিয়াছে। দুঃখে ও বেদনায় প্রাণ আমার বিদীর্ণ হইবার উপক্রম হইয়াছে। কিন্তু কে বুঝে এই দুঃখ! মানুষ আজ স্বার্থান্ধ, অন্যের কথা শুনিবার বা বুঝিবার অবসর এখন তাহাদের নাই। হয়তো স্ব-জাতীয়দের মত আমারও দেহ একদিন শাণিত কুঠারে দ্বি-খণ্ডিত হইবে; আমি সে দিনের অপেক্ষায়ই আছি। চোখের সম্মুখে এই হৃদয়হীন কার্য প্রত্যক্ষ করা অপেক্ষা মৃত্যুই শ্রেয়। (—শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় )
ট্যাগঃ একটি বট গাছ এর আত্মকাহিনী, জেনে নিন একটি বট গাছ এর আত্মকাহিনী, বট গাছ কী? বট গাছ এর আত্ম কাহিনী, বট গাছ কি ধরনের উদ্ভিদ।