একটি পয়সার আত্মকাহিনী রচনা । Paisa

অনুচ্ছেদ সমূহ
একটি পয়সার আত্মকাহিনী রচনা। উকিপিডিয়া অনুসারে, পয়সা বিভিন্ন দেশে ব্যবহৃত মুদ্রার একটি একক। বাংলাদেশী এক টাকার ১০০ ভাগের এক ভাগকে “পয়সা” বলা হয়। ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের এক রুপির ১০০ ভাগের এক ভাগের নাম পয়সা। আবার, ১ ওমানি রিয়ালের ১০০০ ভাগের এক ভাগকে বলে বাইসা। পয়সা শব্দটি ফার্সি ভাষা থেকে ঋণকৃত শব্দ।
একটি পয়সার আত্মকাহিনী
ভূমিকা :
আমি আপনাদের কাছে আমার বিনীত পরিচয় দিতে বসেছি। আমি একটি পয়সা। এক টাকার একশত ভাগের মাত্র এক ভাগ। সুতরাং আপনারা বুঝতে পারছেন যে, আমি সংসারে মূল্যহীন না হলেও বিশেষ মর্যাদার অধিকারী নই। পৃথিবীর অতি প্রয়োজনীয় এক পদার্থের বংশে আমার জন্ম কিন্তু স্থান সর্বনিম্নে। আমার চেয়ে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী যারা তাঁরা, টাকা, পঞ্চাশ পয়সা, পঁচিশ পয়সা, দশ পয়সা ও পাঁচ পয়সা নামে পরিচিত। আমি মাত্র একটি পয়সা। তাও আবার ১৯৮২ সালের পয়সা, যাকে কেউ গুরুত্বই দিতে চায় না। দশমিক পদ্ধতির হিসাবে গ্রহণ করায় আমার যে সামান্য মর্যাদা আছে সেটাই আমার একমাত্র লাভ। এক টাকা, পঞ্চাশ পয়সা, পঁচিশ পয়সা, দশ পয়সা ও পাঁচ পয়সার যে সম্মান ও মর্যাদা আছে তা আমার নেই, সত্যিকথা বটে; তবে আমার অস্তিত্ব তো কেউ অস্বীকার করতে পারে না, করলে টাকার হিসাবেই গোলমাল হয়ে যাবে।
জন্ম-বৃত্তান্ত :
আমার জন্ম হয়েছে টাকশালে। সেখান থেকে আমাকে ব্যাংকে রাখা হয়। ব্যাংক থেকে আমাকে বাজারে ছাড়া হবে বলে আমি কানাঘুষা শুনেছিলাম। হ্যাঁ, যথার্থই একদিন আমাকে ছাড়া হলো। ব্যাংক কাউন্টার থেকে আমি ছাড়া পেলাম। এক ভদ্রলোকের হাজার টাকার নোট আর তার সাথে কিছু পঞ্চাশ পয়সা (আধুলি) ও পঁচিশ পয়সা, কিছু দশ ও পাঁচ পয়সা এবং তাদের সাথে আমিও স্থান পেলাম।
সেদিন আমার মতো এই ক্ষুদ্র জিনিসটির মনে যে অনির্বচনীয় আনন্দের জোয়ার বয়ে গিয়েছিল তাকে প্রকাশ করার ভাষা ছিল না আমার। মনে মনে এ অহংকার ছিল। যে, আমাকে ছাড়া কারো কোন কাজ চলবে না। আমাকে বাদ দিলে সংসারটাই যে, অচল। বন্যার রিলিফ ফাণ্ড বলুন, ভিক্ষুককে ভিক্ষাদান বলুন, রাখাল বালক বলুন, সর্বার আমার ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতা।
আমার মর্যাদা :
কাজের সুবিধার জন্য কেউ তো শুধু টাকা দিয়েই জিনিস, বেচা-কেনা করে না টাকার সাথে চাই পঞ্চাশ পয়সা, পচিশ পয়সা, দশ পয়সা, পাঁচ পয়সা ও এক পয়সা অর্থাৎ আমার মতো এই অর্বাচীন আহমকেরও অতিজাতের দলে ভিড়ে যেতে অসুবিধা হয় না। মাছের বাজারে, মুদির দোকানে, কাপড় চোপড়ের দোকানে টাকা, আধুলি, সিকি, দশ পয়সা ও পাঁচ পয়সার দরকার। কিন্তু আমার প্রয়োজনও নেহায়েৎ ফেলনা নয়। কারণ আমার একশত ভাগের যোগফলই তো টাকা। টাকা মানে এক টাকার কাগজের নোট; লোকের হাতে হাতে ঘুরতে-ফিরতে এই টাকার চেহারাটা কেমন হয় তা আপনারা দেখেছেন? দীর্ঘদিন পরে কাগজী নোটের চেহারা নোংরা হয়ে যায়, ছিঁড়ে যায়, অচল হয়ে যায়। বাজারে তখন এদের অস্তিত্ব থাকে না। আমাদের ক্ষমতা কিন্তু এইসব অভিজাত ও ক্ষীণায়ু কাগজী নোটের চেয়ে বেশি। তখনো বাজারে আমাদের আদর, এক জনের পকেট থেকে অন্যের পকেটে, একের আঁচল থেকে অপরের ফতুয়ার পকেটে নিঃসঙ্কোচে চলতে ফিরতে পারি।
বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরষ্কার বিতরণ উপলক্ষে নিমন্ত্রণ পত্র
অভিজ্ঞতার বর্ণনা :
এবার আমার অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমি একটি পয়সা। আমার জীবনের অনেক ক’টি বছর পার হয়ে গেছে। আমার জন্য হয়েছিল। – ১৯৪৭ সালে। এক পিঠে শাপলা ফুল আর অন্য পিঠে বাংলাদেশ-নামাঙ্কিত হয়ে আমি ঘরে-বাইরে, হাটে-বাজারে, মসজিদে-মন্দিরে, উৎসবে অনুষ্ঠানে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি। নতুনত্বের জৌলুস এখন আর নেই। চেহারাটা বিবর্ণ হয়েছে। কোনদিন কোন আঘাত পাইনি। কেবল একবারের কথা মনে পড়ে। আমি একটি পয়সা মাত্র অথচ অর্থশালী কনট্রাক্টর ও ধনী ব্যবসায়ীর প্রাসাদোপম অট্টালিকা থেকে গরীবের পর্ণকুটির পর্যন্ত যার অবাধ গতি তাকেই কিনা একদিন এক ভিক্ষুক ছোকরা অবজ্ঞা করে ঢিল মেরে ফেলে দিল। এক বড়লোকের বাড়িতে ঐ চালচুলোহীন ছোকরা ভিক্ষে চাইতে এসেছিল। বাড়ির কর্তা বা অন্য কেউ ওর ইনিয়ে বিনিয়ে কান্নাকাটিকে আমল দিলেন না- কেবল ঐ বাড়ির কুসুমকলি ছোট্ট মেয়েটি কোথা থেকে কুড়িয়ে পেল আমাকে। অমনি আমাকে ভিক্ষুক ছেলেটার হাতে তুলে দিয়ে ওর পানে চেয়ে রইল। ছেলেটা বুঝি ক্ষুধার্ত ছিল। দশটা-পাঁচটা পয়সা হলেও হয়তো ও রাগ করতো না। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল খিড়কির দরজার সামনে তার দিকে কারো দয়া হলো না ভিক্ষা দিল না কেউ; কথাও বলল না। শুধু সেই লাবণ্যবতী ছোট্ট মেয়েটি কথা না বলে আমাকে তার হস্তে ন্যস্ত করলো। অমনি সঙ্গে সঙ্গে ভিখারী ছেলেটা আমাকে নিক্ষেপ করলো সেই বাড়ির ফুলের কেয়ারির মাঝখানে। আর একদিন ঐ বাড়ির চাকা ছোকরা আমাকে কুড়িয়ে পেলো এবং পাশের দোকানে গিয়ে আমাকে দিয়ে একটি বিড়ি ক্রয় করলো। এই চাকর ছেলেটা ভয়ানক বোকা। জানে না ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে অতিশয় ক্ষতিকর। যাই হোক, ছেলেটা বিড়িতে আগুন ধরিয়ে মহানন্দে টানতে লাগল।
আমি ক্ষুদে দোকানির থলির ভিতরে বেশ কিছুদিন বন্দী জীবনযাপন করলাম। পরে দোকানি তার থলির যাবতীয় খুচরা পয়সা তার স্ত্রীর হাতে তুলে দিল। তার খুচরা পয়সাগুলি গুণে গুণে হিসাব করলো ১৪ টাকা ৫২ পয়সা। তার ৫২ পয়সার মধ্যে আমিও ছিলাম। বর্তমানে সেই মহিলার হাতে আমি বাক্সবন্দী আছি। পৃথিবীর আলো-হাওয়া, রূপ-রস-গন্ধ-বর্ণ-স্পর্শের জন্য আমার অন্তরাত্মা উৎসুক হয়ে উঠেছে। কিন্তু জানি না সে কবে? আপনারা আমার ভবিষ্যৎ জীবন সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন কি?
লেখা পাঠিয়েছে – অনিমা দত্ত, বাংলাদেশ
ট্যাগঃ একটি পয়সার আত্মকাহিনী , একটি পয়সার আত্মকাহিনী রচনা