
স্কুল জীবনের স্মৃতি (Memories of school life): স্কুল জীবন শিক্ষার ও উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি একটি মৌলিক স্তর, যা ছাত্রদের জীবনের আরও উচ্চতর শিক্ষার মাধ্যমে প্রস্তুত করে। এটি একটি জায়গা যেখানে ছাত্ররা নিয়মিত ভাবে শিক্ষার পাশাপাশি সমাজ ও সামাজিক অভিজ্ঞতা অর্জন করে।
স্কুল জীবনে ছাত্ররা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী ও কমিউনিটি থেকে একত্র হয়ে শিক্ষার উপকরণ গ্রহণ করে এবং পাঠ্যবই থেকে শিক্ষা লাভ করেন। সমাজের উদ্দেশ্যে স্কুল শিক্ষা ছাড়াও ছাত্রদের সামাজিক সচেতনতা উন্নয়ন করে এবং একটি মজার ও শিক্ষাপ্রদ জীবন অভিজ্ঞ করার সুযোগ দেয়।
স্কুল জীবন ছাত্রদের ক্ষুদ্র থেকে অধিকতর বয়সে পর্যবেক্ষণ করে তাদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন করে, যেমন শিক্ষার ক্ষেত্রে, সামাজিক ক্ষেত্রে এবং বাস্তব জীবনে। এছাড়াও, স্কুল জীবন ছাত্রদের পরীক্ষাগুলির জন্য প্রস্তুত করে তাদের অভিজ্ঞতা উন্নয়ন করে জীবনে এগিয়ে চলার জন্য। [ স্কুল জীবনের স্মৃতি রচনা । বিদ্যালয়ের স্মৃতি প্রবন্ধ রচনা ]
আমার স্কুল জীবনের স্মৃতি
যখন আমার বয়স দশ বছএ, তখন আমি সর্বপ্রথম স্কুলে ভর্তি হই। এই দীর্ঘ দশ বছরে যাবৎ আমি কোন বাঁধাধরা নিয়ম-কানুনের মধ্য দিয়ে লেখাপড়া করি নি। প্রথমত, জন্মের পর থেকে পাঁচ বছর কাল পর্যন্ত খেলাধুলায় কাটে গেছে। পাঁচ বছরের পড় অনেক ছেলে-মেয়ে স্কুলে পাঠশালায় ভর্তি হয়; কিন্তু আমার বাবা অতি অল্প বয়সে ছেলেদেরকে শৃঙ্খলার বশবর্তী করে শিশুর সরল প্রাণে ভীতি সঞ্চারের জন্য মোটেই পক্ষপাতী ছিলেন না; তাঁর মতে অল্প বয়সে স্কুল-পাঠশালায় দিলে ছেলে মেযেদের বুদ্ধিবৃত্তি বাধাপ্রাপ্ত হয়। শিক্ষকের ভয়ে অথবা মাতাপিতা প্রভৃতি অভিভাবকের তাড়নায় এই সব কচিশিশু অনিচ্ছা সত্ত্বেও পাঠ অভ্যাস করতে বাধ্য হয়। এর ফল এই হয় যে, পাঠের নামে একটা বিভীষিকা তাদের অন্তরকে গ্রাস করে। তারা বোধ হয় কখনও লেখাপড়াকে আনন্দের সাথে গ্রহণ করতে পারে না। অতএব, পাঁচ বছর আমি স্বচ্ছন্দে বিহঙ্গের মত পল্লীক্রোড়ে জীবন কাটিয়েছিলাম। [ স্কুল জীবনের স্মৃতি রচনা । বিদ্যালয়ের স্মৃতি প্রবন্ধ রচনা ]
পাঁচ বছর বয়ঃক্রমকালে আমি বাড়িতেই লেখাপড়া শুরু করেছিলাম। কিছুকাল অধ্যয়ণ করার পরই আমার অধ্যয়নের প্রতি অনুরাগ জন্মিয়ে গিয়েছিল। তারপর , বছরের মধ্যেই আমি উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার উপযুক্ত হয়ে উঠলাম। [ স্কুল জীবনের স্মৃতি রচনা । বিদ্যালয়ের স্মৃতি প্রবন্ধ রচনা ]
দশ বছর বয়সে ঢাকা কলেজিয়েট হাই স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীতে আমি ভর্তি হই। এই স্কুলের কড়া নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে আবদ্ধ থাকা প্রথমটা আমার পক্ষে খুবই কষ্টকর হলেও ক্রমশ নিজেকে নিয়মানুবর্তী করে নিতে সমর্থ হয়েছিলাম।
আমি বেশ বুঝতে পেড়েছিলাম, স্কুলের নিয়ম-শৃঙ্খলার বাইরে যাবার কোন উপায় নেই, গেলেই অনর্থের সূত্রপাত হবে। তাই সব আইন-কানুন মাথা পেতে নিলাম। এছাড়া, আমার আর একটা বিশিষ্ট গুণ ছিল নম্রতা। ছাত্রজীবনে নম্রতা যে কত বড় গুণ, তাঁ বলে শেষ করা যায় না। বাবা আমাকে শিখিয়েছিলেন, “যাঁরই কাছ থেকে কিছু শিক্ষা পাবে, তার প্রতি বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা রেখো।” আমি তদনুসারে প্রত্যেক শিক্ষকের প্রতি মনে মনে প্রগাঢ় শ্রদ্ধা পোষণ করতাম। এই দুটি গুণের জন্য বিদ্যালয়ের মধ্যে আমার খ্যাতি অচিরে ছড়িয়ে পড়ল। প্রত্যেক শিক্ষকের স্নেহ ও সহানুভূতি লাভের কথা আজও আমার মনে পড়ে। আমার স্কুল জীবন যে কত আনন্দের, কত যে গৌরবের ছিল, তা আজ স্কুল ছেড়ে আসে বুঝতে পারছি। [ স্কুল জীবনের স্মৃতি রচনা । বিদ্যালয়ের স্মৃতি প্রবন্ধ রচনা ]
বাড়িতে আমার কোন বাঁধাধরা নিয়ম ছিল না, প্রাত্যহিক কোন কাজ তালিকাও ছিল না। অতএব, স্কুলের কাজগুলি যথারীতি সম্পন্ন করাই আমার একমাত্র কর্তব্য ছিল। এতে আমি প্রচুর আনন্দ পেতেম। আমার চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য ছিল, কোন একটি কাজ শেষ না হলে অন্য কিছু করতাম না। অনেক দিন বিদ্যালয় থেকে ফিরে লিখতে বসে যেতাম। কেউ ডাকলে বিরক্ত হতাম। স্কুল-জীবনে ছাত্রদের একটা জেদ থাকা ভাল, বাবা আমার এইভাবে খেয়ালে বাধা দেন নি। এমন কি, উপর্যুপরি তিন চারদিন খেলে বেরিয়েছি তাতে তিনি কিছুই বলেন নি। আমার স্কুল-জীবনের সাথে বাড়িতে যতটুকু স্বাধীনতা, পেয়েছিলাম, তাতে আমার যথেষ্ট উপকার হয়েছে। আজকাল ছাত্রেরা ঘরে-বাইরে তাড়া খেয়ে দিশাহারা হয়ে পড়ে। পঞ্চম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত আমি এই স্কুলে পরেছি। এই ছয় বছরের মধ্যে আমি অনেকের সঙ্গে মিসেছি। মুসলমান, খ্রীষ্টান, হিন্দু প্রভৃতি বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী ছাত্রদের সঙ্গে প্রাণ খুলে কথাও বলেছি অথচ তাদের চাল-চলন রীতিনীতির মনোভাব শিক্ষা করি নি। স্কুল জীবনের এই অভিজ্ঞতাই আমার জীবনের উন্নতির পথে সহায়ক হয়েছে। তখন ইচ্ছা ছিল, আকাঙ্ক্ষা ছিল, অনুসন্ধিৎসা ছিল নতুন কিছু জানবার জন্য, তার ফলে সংসারে বিভিন্ন কাজে নানারকম লোকের সঙ্গে মিশতেও কোন অসুবিধা হয় নি। [ স্কুল জীবনের স্মৃতি রচনা । বিদ্যালয়ের স্মৃতি প্রবন্ধ রচনা ]
স্কুল জীবনের হাসি-কান্না সবই পরম মাধুর্যমণ্ডিত। উত্তরকালে জীবনের পাতায় জোড়া এই স্মৃতি স্মরণ করে মানুষ মাত্রই আনন্দ লাভ করে থাকে। বাল্যজীবনের আনন্দ অনাবিল ও অতুলনীয়। কত কবি, কত লেখক পরিণত বয়সে ছাত্র জীবনের কথা স্মরণ করে আক্ষেপ করেছেন, পুনরায় বালক থেকে চেয়েছিলেন। আমার স্কুল জীবন বিচিত্র ঘটনায় পরিপূর্ণ ছিল। তরুণ জীবনের পাতায় পাতায় যে ‘বেদনা জমাট বাঁধা অবস্থায় ছিল তা পরবর্তী জীবনের শত সুখ ও আনন্দের মধ্যে ভুলতে পারি নি। সে জীবন দুঃখপূর্ণ, বিষাদঘন ছিল বটে, কিন্তু তার সুরভি এখনো আমার প্রাণে পুলক শিহরণ তোলে। কাজেই আজ পরিণত বয়সেও নানা ঝঞ্ঝাটের মধ্যেও ভুল জীবনের স্মৃতিকথাকে অত্যন্ত সঙ্গোপনে মনের মণিকোঠায়, যত্ন করে রেখেছে। এ কোন দিনই ভলার নয়। [ স্কুল জীবনের স্মৃতি রচনা । বিদ্যালয়ের স্মৃতি প্রবন্ধ রচনা ]