মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা রচনা 600 শব্দের মধ্যে
সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার । প্রাথমিক ভাষা বা স্থানীয় পড়াশোনা

অনুচ্ছেদ সমূহ
মাতৃভাষা, প্রথম/প্রাথমিক ভাষা বা স্থানীয়/নিজস্ব ভাষা পরিভাষাটির সংজ্ঞা পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। তবে মাতৃভাষা মানে মায়ের ভাষা, অথবা এমন কোন ভাষা যা তার বিকাশের জন্য মায়ের মতই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ যে ভাষায় কথা বলতে সবচেয়ে বেশি পারদর্শী, যে ভাষাটি সে তার পিতামাতা বা অভিভাবকের কাছ থেকে ছোটবেলায় শিখেছে ও ভাষাটি যে অঞ্চলে বহুল প্রচলিত, সে অঞ্চলের মানুষের মতই ভাষাটিতে কথা বলতে সক্ষম, তাকে সাধারণভাবে মাতৃভাষা বা প্রাথমিক ভাষা বলা হয়।
মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা
অথবা,
সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার
সূচনাঃ
আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। বাংলা ভাষায় আমরা কথা বলি। কাজেই আমরা বাঙালী। শৈশবে এই ভাষায় আমাদের প্রথম বাক্য স্ফূর্তি হয়েছে। এই ভাষায় আপনার মনের ভাব প্রকাশ করতে পেড়েছে। এই ভাষা লিখেছে, এই ভাষা পড়ে, এই ভাষায় কথা বলে আমরা যত আনন্দ লাভ করি এমন আর কোন ভাষায় নয়।
কবি বলিয়াছেন :
নানা দেশের নানা ভাষা, বিনা স্বদেশী ভাষা মেটে কি আশা। সত্যই তাই। নিজস্ব ভাষা ব্যতীত কিছুতেই আশা পূরণ হয় না। প্রত্যেক মানবের কাছে তার মাতৃভাষা বিশেষ শ্রদ্ধার এবং সম্মানের বস্তু। সুতরাং মাতৃভাষা সকলের কাছে অপর সব ভাষা অপেক্ষা মধুরতম ।
মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাঃ
শৈশবে মাতৃক্রোড়ে থেকে যে ভাষায় সর্বপ্রথম মানবশিশু কথা বলে সেই ভাষার বর্ণের সাথে পরিচিত হওয়া সর্বাগ্রে প্রযোজন। অতঃপর সেই ভাষাকে ভিত্তি করে তারই মাধ্যমে উচ্চতর শিক্ষায় অগ্রসর হতে হবে। এ না হয়ে যদি অন্য কোন ভাষার মাধ্যমে কেউ বিদ্যা শিক্ষা লাভ করতে যত্নবান হয় তা হলে তার বিদ্যাশিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে; আপনার মাতৃ-ভাষা সম্পূর্ণরূপে আয়ত্ত না করতে পারলে তার সম্যক জ্ঞানার্জন হবে না এবং অপর ভাষাও তার কাছে একটা দুর্জেয় বিষয় হয়ে রইবে। এখানে দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করতে পারা যায়, কিণ্ডারগার্টেন বিদ্যালয়সমূহের শিক্ষাপদ্ধতির কথা। ইংরেজী ভাষার মাধ্যমে এই সকল বিদ্যালয়ে শিক্ষাদান কাজ সম্পন্ন নিয়ে থাকে। এই দেশের বাংলা ভাষাভাষী বালক-বালিকারা কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়ে ইংরেজী ভাষার মাধ্যমে বিদ্যাশিক্ষা করে থাকে। এই আমাদের দেশের অভিভাবকদের ভ্রান্তিপূর্ণ অনুকরণপ্রিয়তার উদাহরণ। যে-সকল কচি শিশুর জীবনের প্রথম পদক্ষেপ এইরূপ ত্রুটি ও বিচ্যুতির মধ্য দিয়া অতিবাহিত হয়ে থাকে, উত্তরকালে বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাদের মনোবৃত্তি বিদেশী ভাবাপন্ন হয়ে যায়। জাতীয় শিক্ষা অপেক্ষা বিজাতীয় শিক্ষা তাদের অন্তরে প্রসার লাভ করে থাকে। নিজের দেশ অপেক্ষা অন্য দেশ এবং অপর ভাষাকে সে আপনার বলে চিন্তা করতে শিখে। এ অপেক্ষা লজ্জাকর এবং দুঃখজনক ব্যাপার আর কিছুই হতে পারে না।
মাতৃ-ভাষার প্রতি উদাসীনতা এবং অবহেলা আমাদের জাতীয় জীবনের অপমৃত্যু বলে মনে করতে হবে। আমাদের মাতৃ-ভাষা কখনই দীন-হীন নয়। সমগ্র এশিয়া মহাদেশের মধ্যে বাংলা ভাষা বিশ্ব-সাহিত্যে স্থান লাভের গৌরব অর্জন করেছে। এই ভাষার প্রতি যাঁরা অবজ্ঞার ভাব এখনও পোষণ করেন তাঁদের বুদ্ধিহীনতা সত্যই অনুকম্পার যোগ্য।
মাতৃ-ভাষার লেখকবৃন্দ ও এক শতাব্দীর অধিক কাল থেকে এ দেশীয় মনীষিবৃন্দ বাংলা ভাষার উন্নতিকল্পে লেখনী ধারণ করেছে। প্যারীচাঁদ মিত্র, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর থেকে আরম্ভ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মীর মোশাররফ হোসেন, কাজী নজরুল ইসলাম এই ভাষায় যে অতুলনীয় সাহিত্য সৃষ্টি করেছে, ভাষাকে সম্পদশালিনী এবং ঐশ্বর্যশালিনী করেছে, তা বিদেশী যে কোন সমৃদ্ধশালী ভাষার সাথে প্রতিযোগিতা করতে সমর্থ। এই ভাষায় যে সাহিত্যের সৃষ্টি হয়েছে তা প্রতিবেশীর ভাষার সাহিত্য অপেক্ষা শ্রেয় এবং তা অপর ভাষায় অবশ্য অনুকরণীয়, এ নিঃসন্দেহে বলা যাতে পারে।
মাতৃভাষার অবদানঃ
জাতীয় জীবনকে শক্তিশালী করতে হলে, স্বদেশের প্রতি মমত্ববোধ জাগ্রত করতে হলে, একতা-বন্ধনকে নিবিড়তর করতে হলে, কেবল মাতৃ-ভাষার মাধ্যমেই তা সম্ভব। যার নিজের প্রতি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস নেই, মাতৃভাষাকেও সে মর্যাদা দিতে জানে না। সামান্য লেখাপড়া শিখে আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধবদের কাছে বাংলায় পত্র লিখতে অনেকে লজ্জাবোধ করে। তারা গর্ব করে বলে বাংলা ভাষায় চিঠি লেখা তাদের দ্বারা সম্ভব নয়। এই ভাষাতে ঠিকমত সাজিয়ে গুছিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারা যায় না। পক্ষান্তরে, লেখনী ধারণ মাত্র চিন্তাধারা ইংরেজী ভাষায় অবিরাম প্রকাশ করে থাকে। এই মানসিকতা অদ্যকার দিনে শুধু দাস মনোবৃত্তির পরিচায়ক নয়, এ আত্মদ্রোহ বলে গণ্য।
বস্তুতপক্ষে, মাতৃভাষা মানব জীবনের অমৃতরসায়ন। আজ পৃথিবীর সকল সভ্য-দেশে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা-দীক্ষা, রাষ্ট্র পরিচালনার প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হচ্ছে। যে কোন দেশ পৃথিবীর অন্যান্য ভাষা শিক্ষা না করা সত্ত্বেও শুধু মাতৃ-ভাষার মাধ্যমে উন্নতির উচ্চ শিখরে আরোহণ করতে পারে। শিল্প-বাণিজ্য, জ্ঞান-গরিমার উন্নতির মূলেও আছে এই মাতৃ-ভাষা। এই ভাষার মাধ্যমে বহু দেশের ও রাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে শিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে এবং সেই সব দেশ সর্বক্ষেত্রে উন্নতি প্রদর্শন করে জগতের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করতে পেড়েছে।
উপসংহার :
মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ সম্পর্কে আজ পৃথিবীর মনীষিবৃন্দ একমত। যাঁদের মনে দেশাত্মবোধ আছে, তাঁরা সকলেই মাতৃ-ভাষাকে যথোচিত সম্মান প্রদান এই কাম্য। এই না করলে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের জাতীয় জীবনের মৃত্যু অনিবার্য।
লেখা পাঠিয়েছে- আব্দুল হাসান করিম, বাংলাদেশ