কৃষিপড়াশোনাস্বাস্থ্য

ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতিকারক প্রভাব ও নিরাপত্তার উপায়

ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতিকারকঃ ঘূর্ণিঝড় বা ঘূর্ণিবাত্যা (Cyclone)একটি বিধ্বংসী ঝড় বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়। ক্রান্তীয় এবং নাতিশীতোয় অঞ্চলের উয় সমুদ্রের উপরের বাতাস প্রচণ্ড উত্তাপে হালকা হয়ে কখনো কখনো অতি দ্রুতগতিতে উপরের দিকে উঠে যায়। ফলে সেই জায়গায় একটি প্রবল বায়ুর নিম্নচাপকেন্দ্রের সৃষ্টি হয়। তখন সেই নিম্নচাপকেন্দ্রের চারপাশের বায়ু সেই জায়গা পুরণ করার জন্য প্রচন্ড গতিতে (ঘণ্টায় প্রায় ৫০ কিমি) ছুটে আসে। এর ফলে শক্তিশালী কেন্দ্রমুখী, ঊর্ধ্বগামী যে প্রবল বায়ুপ্রবাহ বা ঝড়ের সৃষ্টি হয় তাকে ঘূর্ণিঝড় বলে।

ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতিকারক প্রভাব ও নিরাপত্তার উপায়

ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতিকারক প্রভাব

  •  ঘরবাড়ি এবং পরিকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতি : প্রবল ঝড়ে হালকা চালযুক্ত ঘরবাড়ি ও ভঙ্গুর পরিকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবার ঝড়ের পরে ভারী বৃষ্টি, বন্যা এবং উপকূল অঞ্চলের উত্তাল ঢেউ-এ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পার্শ্ববর্তী এলাকা।
  • প্রাণহানির ঘটনা ও জনস্বাস্থ্য ঝড়ে ভেঙে যাওয়া বাড়িঘর ও বস্তুর আঘাতে এবং বন্যার জলে ভেসে গিয়ে প্রচুর প্রাণহানি হয়। তাছাড়া বন্যাপ্লাবিত এলাকায় কলেরা ও ডায়ারিয়ার মতো রোগ ছড়ায় যা মহামারির আকার নিতে পারে।
  • পানীয় জল সরবরাহ : ভূগর্ভস্থ জল ও নলবাহিত জল উভয়ই বন্যার জলে দুষিত হতে পারে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব দেখা দেয়।
  • শস্যের ক্ষতি ও খাদ্য সরবরাহ প্রবল ঝড় ও বৃষ্টির জল জমে মাঠের ফসল ও মজুত শস্যের ব্যাপক ক্ষতি করে। জলোচ্ছ্বাসের ফলে সমুদ্রের নোনা জল চাষের জমিতে ঢুকে গিয়ে জমি অনুর্বর করে তোলে। বন্যার জলে ডুবে যাওয়ায় খাদ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।
  • যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষতি প্রবল ঝড় বিদ্যুতের ও যোগাযোগ ব্যবস্থার টাওয়ার, বিদ্যুৎ ও টেলিফোনের খুঁটি, টেলিফোন লাইন, অ্যান্টেনা, স্যাটেলাইট ডিস এবং সম্প্রচার ব্যবস্থাকে একেবারে ভেঙে তছনছ করে দিতে পারে। রাস্তা ও ট্রেনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হতে পারে। তাই ঘূর্ণিঝড় আক্রান্ত এলাকায় ত্রাণ পৌঁছোতে অসুবিধা হয়।

এটিও পড়ুন – ইংরেজি রিপাের্ট লেখার সঠিক নিয়মাবলী

ঘূর্ণিঝড়ের বিপর্যয় কমানোর কয়েকটি পদক্ষেপ।

  • বৃক্ষরোপণ : ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা কমাতে দৃঢ়মূল ঘনসন্নিবিষ্ট বৃক্ষরোপণ ভীষণ জরুরি। উপকূল অঞ্চলে গাছ লাগানো বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে উপকূলরেখা বরাবর ছোটো থেকে বড়ো এই সারিতে গাছ লাগিয়ে সবুজায়ন ঘটানো-র মাধ্যমে বিপর্যয়ের মাত্রা বা প্রভাব কমানো যেতে পারে।
  • আগাম সতর্কতা বছরের কোন সময়ে কোন কোন অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় হওয়ার সম্ভাবনা আছে তা ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকার মানচিত্র এবং অতীতের আবহাওয়ার নথি, বিগত বছরগুলিতে বাতাসের গতিবেগের পরিসংখ্যান ইত্যাদি তথ্যের দ্বারা ঘূর্ণিঝড়ের ধরন, ক্ষয়ক্ষতির তীব্রতা ও ব্যাপকতা সম্পর্কে আগাম জানা যায়। এছাড়া আবহাওয়া সংক্রান্ত নথি, যাতে হাওয়ার গতিবেগ ও দিক্‌নির্দেশ করা থাকে তা থেকে কোনো অঞ্চলে ঝড়ের সম্ভাবনা বোঝা যায়। ফলে অনেকদিন আগে থেকেই ঘূর্ণিঝড় আসার আগাম পূর্বাভাস আবহাওয়া দফতর দিয়ে থাকে; সেইমতো সতর্কতা গ্রহণ করলে ক্ষয়ক্ষতি, জীবনহানির ঘটনা কম ঘটে।
  • নির্দিষ্ট নীতি : জমির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নীতি থাকা দরকার এবং বিল্ডিং কোড যাতে ঠিকঠাক মানা হয় তা নিশ্চিত করা দরকার। বিপদসংকুল এলাকাগুলিতে কেবলমাত্র পার্ক, চারণভূমি, খেলার মাঠ প্রভৃতিকে রাখা উচিত। নির্মাণ কাজের জন্য স্থাপত্যবিদ্যার সঠিক পরামর্শ নেওয়া উচিত।

ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় ছাত্রছাত্রী ও জনগোষ্ঠীর ভূমিকাঃ

তৃণমূলস্তরে গ্রামের যুবগোষ্ঠী, শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী ও জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য গোষ্ঠী গঠন করতে হয়। প্রতিটি এলাকার অধিবাসীদের সুবিধা অনুযায়ী পাঁচ থেকে দশজন সক্রিয় সদস্য নিয়ে এক-একটি সক্রিয় গোষ্ঠী গঠন করতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের সামর্থ্য অনুযায়ী এই জনগোষ্ঠীতে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বণ্টন করতে হবে।

কোনো একটি এলাকার বিপর্যয়ের পূর্ববর্তী সময়, বিপর্যয়ের সময় ও বিপর্যয়ের পরবর্তী সময়ের জন্য সুসংহত দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা প্রস্তুত করার সময় মোটামুটি ৯টি সক্রিয় গোষ্ঠী গঠন করতে হবে। গোষ্ঠীগুলি হলো-

  1. দুর্যোগের সতর্কীকরণ গোষ্ঠী
  2. বিপর্যস্ত এলাকা থেকে সরিয়ে আনা ও উদ্ধারকার্য সম্পাদন গোষ্ঠী
  3.  প্রাথমিক শুশ্রুষা ও চিকিৎসা গোষ্ঠী
  4.  জল ও শৌচাগার গোষ্ঠী
  5.  মৃতদেহ সৎকার গোষ্ঠী
  6. পরামর্শদাতা গোষ্ঠী
  7.  ক্ষয়ক্ষতি মূল্যায়ন গোষ্ঠী
  8. ত্রাণ ও সমন্বয় গোষ্ঠী
  9.  আশ্রয়স্থল ব্যবস্থাপনা গোষ্ঠী

ঘূর্ণিঝড়ে প্রাথমিক নিরাপত্তার উপায় অবলম্বন ।

কী করবে:

সর্বশেষ আবহাওয়া বিষয়ক সতর্কর্তা ও পরামর্শের জন্য রেডিয়ো/টিভির তথ্য জানতে হবে ও অন্যদের জানিয়ে দিতে হবে, নিয়মিত খবর শুনতে হবে।

  • সামাজিক সতর্কতামূলক পদ্ধতির দিকে নজর রাখতে হবে।
  • শিশু, মহিলা, বৃদ্ধ ও অসুস্থ মানুষদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
  • সরকারি সূত্রের তথ্য অনুসরণ করতে হবে।
  • জরুরিকালীন সরঞ্জাম তৈরি রাখতে হবে। যাতে থাকবে পোর্টেবল ট্রানজিস্টর/রেডিয়ো সেট, ব্যাটারি, টর্চ, অতিরিক্ত ব্যাটারি, হারিকেন, ফার্স্ট এইড বক্স, শুকনো খাবার, পানীয় জল ও অন্যান্য ন্যূনতম অত্যাবশ্যক সামগ্রী।
  • জরুরিকালীন কিছু ফোন নম্বর (পুলিশ-প্রশাসন, হাসপাতাল, স্থানীয় চিকিৎসক, জন প্রতিনিধি ইত্যাদি) হাতের কাছে রাখতে হবে।
  • বাড়িতে হাতের কাছে রাখতে হবে প্লাস্টিক শিট, প্লাস্টিকের দড়ি, রাবার টিউব, ওয়াটারপ্রুফ ব্যাগ ইত্যাদি। এগুলো সংকটজনক পরিস্থিতিতে কাজে লাগতে পারে।
  • খাদ্যশস্য/কৃষিজাত সামগ্রী নিরাপদ প্লাস্টিক ব্যাগে মজুত রাখতে হবে।
  • কাচের জানালা বন্ধ রাখতে হবে ও শাটার নামিয়ে রাখতে হবে। যেখানে প্রয়োজন সেখানে দরজা-জানালা করে নিতে হবে।
  • আশ্রয় নেওয়ার জন্য সাইক্লোন শেলটার ও নিরাপদ বাড়ি দেখে রাখতে হবে, কর্তৃপক্ষের পরামর্শ পেলে পরিবারের সঙ্গে সাইক্লোন শেলটারে চলে যেতে হবে। যাবার সময় কিন্তু নগদ টাকা, মূল্যবান সামগ্রী, কাগজপত্র ও জরুরিকালীন সরঞ্জাম নিতে মনে রাখতে হবে। যতদিন প্রশাসন সাইক্লোন শেলটারে থাকতে বলবে ততদিন সেখানে থাকাই বাঞ্ছনীয়।
  • রান্নার গ্যাস লিক করছে কিনা দেখে রাখতে হবে।
  • ঘূর্ণিঝড়ের সময় বাড়ির বিদ্যুৎ সংযোগের মেইন সুইচ বন্ধ করে রাখতে।
  • ঝড়ের পরবর্তীতে বিদ্যুৎস্পৃষ্টতা থেকে বাঁচার জন্য পড়ে যাওয়া বিদ্যুতের লাইন, পোল থেকে ঝুলে থাকা তার, ক্ষতিগ্রস্ত ব্রিজ, বিল্ডিং ও গাছ সম্পর্কে সতর্ক হতে হবে। যেমন ২০১৩ সালে ১২ অক্টোবর ফাইলিন ঝড়ের পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করে ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গের ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব হয়েছিল।

ঘূর্ণিঝড়ে কী করবেন নাঃ

  • অকারণে আতঙ্কগ্রস্ত হবে না বা গুজব ছড়াবে না।
  • জলস্রোত বা নদীর কাছাকাছি যাবে না, বিপদ হতে পারে।
  • ঘূর্ণিঝড়ের সময় উঁচু গাছ, বাড়ি, লাইট পোস্ট ইত্যাদির নীচে দাঁড়াবে না।
  • গবাদিপশুর মৃতদেহ যেখানে-সেখানে নিক্ষেপ করবে না।
  • গাছ কাটা বা জঙ্গল ধ্বংস করা যাবে না।
  • উপকূল অঞ্চলে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বাড়ি নির্মাণ করা যাবে না এবং এ বিষয়ে সরকারি নিয়মকে মান্যতা দিতে হবে।

Source: WBTBCL/Health & Physical Education -VIII

ট্যাগ- ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতিকারক প্রভাব ও নিরাপত্তার উপায়, ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতিকারক প্রভাব ও নিরাপত্তার উপায় PDF, ফ্রী ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতিকারক প্রভাব ও নিরাপত্তার উপায়, ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতিকারক সম্পর্কে ধারনা, ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতিকারক সম্পর্কে বিস্তারিত, ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতিকারক তথ্য।

এগুলিও পড়তে পারেন -

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button