প্রবন্ধ রচনা

আমাদের শিশুসাহিত্য প্রবন্ধ রচনা

আমাদের শিশুসাহিত্য রচনা । শিশুসাহিত্য কাকে বলে

শিশুসাহিত্য (Children’s literature) হল শিশুদের নিয়ে লেখা উপযোগী সাহিত্য। মনে করা হয় ৬-১০ বছর বয়সী শিশুদের মনস্তত্ত্ব বিবেচনায় রেখে সাধারণত এ সাহিত্য রচনা করা হয়। এই বয়সসীমার ছেলেমেয়েদের শিক্ষামূলক অথচ মনোরঞ্জক গল্প, ছড়া, কবিতা, উপন্যাস ইত্যাদিকেই সাধারণভাবে শিশুসাহিত্য বলে। যারা শিশুসাহিত‍্য রচনা করেন তাদের শিশুসাহিত‍্যিক বলা হয়।

আমাদের শিশুসাহিত্য

আমাদের শিশু-সাহিত্য সম্বন্ধে আলোচনা করা খুব সহজ নয়। খাদ্য, বস্ত্র ও শিক্ষা সমস্যার ন্যায় শিশু-সাহিত্যও একটি বিরাট সমস্যা, যদি তা মনে করা হয়। কেননা, উৎকৃষ্ট শিশুসাহিত্য ছাড়া শিশু শিক্ষাদান সম্ভব নয়।

পাশ্চাত্য দেশসমূহের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় যে, সেখানে সাহিত্যক্ষেত্রে শিশু-সাহিত্যের মূল্য একটুও কম নয়। তাঁরা এই চরম সত্য ঠিক মতই উপলব্ধি করেছেন যে, আজকের শিশুই ভবিষ্যতের নাগরিক; দেশের আশা ভরসা। তাদের উন্নতি ও মঙ্গলের অর্থ দেশ ও জাতিরই ভবিষ্যৎ মঙ্গল ও উন্নতি। শিশুর লালন-পালনে কোনরূপ ত্রুটি হলে যেমন তার শরীর সুগঠিত হতে পারে না, তেমনি শিশু-সাহিত্যের প্রতি অবহেলা করলে শিশুর মানসিক খোরাক জোটে না, এবং তার মনও জাতীয় জীবনের উপযোগী হতে পারে না।

বিভাগ পূর্ব বাংলায়ও ঐরূপ ছিল। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ন্যায় বাংলা শিশু সাহিত্যের ক্ষেত্রেও বাঙালী হিন্দুদের দান আছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণ পরিচয়’, মদন মোহন তর্কালঙ্কারের ‘শিশু শিক্ষা’, সীতানাথের ‘আদর্শলিপি’ ও যোগীন্দ্রনাথের ‘হাসিখুসি’ এখনও অতি আদরের সাথে পঠিত হয়ে আসছে।

আমাদের দেশের শিশু সাহিত্যের বেলায় প্রথমেই নাম করতে হয় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের। তাঁকে আমরা জানি শুধু বিপ্লবী ও ধূমকেতুর ন্যায় ভয়ঙ্কর মানুষ বলে। মনে হয়, না জানি কি ভয়ঙ্কর ঐ লোকটি। তাঁর বীণার বাঙ্কারে বুঝি অগ্নিশিখাই ঝরে; কিন্তু কে জানত এই ধ্যানগম্ভীর বিরাট মানুষটির মধ্যেও যে এমন একটা শিশুসুলভ সুকোমল মন আছে, যদি না তিনি তাঁর বীণার সুরে ‘ঝিঙে ফুল’ এর গান গাইতেন।

নজরুলের ‘ঝিঙে ফুল’ শিশু-সাহিত্যের বই এবং ‘পুতুলের বিয়ে শিশু নাটিকা। ‘ঝিঙে ফুলে’র অধিকাংশ কবিতাই হাস্যরস প্রধান। সুবিখ্যাত “লিচু চোর, ‘স্বাদু দাদু’, ‘পিলেপটকা’, ‘প্রভাতী’, ‘খুকী ও কাঠবেড়ালী’ প্রভৃতি কবিতা অনিন্দসুন্দর। কিয়দংশ উদ্ধৃত করি :

“ভোর হলো
দোর খোলো
খুকুমণি ওঠরে।
ওই ডাকে
যুঁই শাখে
ফুল খুকী ছোট রে।
খুকুমণি ওঠ রে।”

 

তাঁর ‘লিচু চোর’ কবিতাটি আবৃত্তি করে ছেলেরা কতই না আনন্দ পায়।

এছাড়া, তাঁর যে সকল কবিতা বিভিন্ন সাময়িক শিশু পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এবং পাঠ্যপুস্তকাদিতে স্থান লাভ করেছে, সেইগুলিও উল্লেখযোগ্য। তন্মধ্যে ‘সাধ’, ‘সওদাগর’, ‘হিন্দু-মুসলমান’, ‘কে দেখেছে’, ‘জীবন ও সূর্য’ এবং ‘মায়া মুকুর’ প্রসিদ্ধ।

পল্লী কবি জসীম উদ্দীন নিয়মিতভাবে শিশু মাসিক ও শিশু বার্ষিকীগুলিতে সুন্দর গল্প ও কবিতা রচনা করতেন। তন্মধ্যে কবিতার সংখ্যাই বেশি। কবি পল্লীর দুলাল, প্রকৃতির ক্রোড়জাত সন্তান ও স্বভাবদরদী, ভাই তাঁর কবিতায় স্বভাবের সৌন্দর্য অকৃত্রিম ও অনিন্দ্যসুন্দর হয়ে ফুটে উঠেছে।

এই ছন্দসৌন্দর্য শিশু-মনকে মুগ্ধ করে। তাঁর রচিত ‘হাসু’ ও ‘এক পয়সার বাঁশী’ বই দুইখানা শিশু মহলে যথেষ্ট সমাদর লাভ করেছে।

কবি বন্দে আলী মিয়া শিশু-সাহিত্যের একজন কৃতী লেখক। তাঁর কবিতা ও গল্প সমান মিষ্টি। তাঁর রচিত ‘চোর জামাই’, ‘গল্পের আসর’, ‘ছোটদের বিষাদসিন্ধু’, ‘মেঘ কুমারী’ প্রভৃতি শিশুমহলে সুপরিচিত। তাঁর কবিতাগুলিও স্বভাব সৌন্দর্যে ও শিশু মনের কল্পনায় পরিপূর্ণ।

কবি গোলাম মোস্তফা রচিত কবিতার মধ্যে ‘কিশোর’, ‘পল্লী জননী’, ‘চড়ুই ভাতি’, ‘বোক্স রাজার দেশ’ প্রভৃতি কবিতা সমধিক প্রসিদ্ধ। তাঁহার ছন্দ রীতি, কল্পনা ও আদর্শবাদ উল্লেখযোগ্য।

কবি কাদের নওয়াজ গল্প ও কবিতা রচনায় সমান সুদক্ষ। তাঁর কবিতা ও গল্পগুলি আমাদেরই দৈনন্দিন জীবন-চিত্র। শিশুদের মনের কথা তিনি সুন্দর, সুললিত ও হৃদয়গ্রাহী করে ফুটিয়ে তোলেন।

বিখ্যাত সাহিত্যিক শেখ হবিবর রহমান ছেলেদের জন্য কিছু কিছু গল্প রচনা করেছেন। তাঁর রচিত ‘ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ’ যখন ঈদ সংখ্যা দৈনিক আজাদে প্রকাশিত হয়, তখনই শিশুমহলে বেশ সাড়া পরেছিল। বাংলা শিশুসাহিত্যে এইরূপ গাথা বিরল। গাথাটি পরে পুস্তকাকারেও প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর ‘হাসির গল্প’, ‘সুন্দর বন ভ্রমণ’ প্রভৃতি বইয়ের নামও উল্লেখযোগ্য।

শেখ ফজলল করিম শিশু-সাহিত্যের একজন শ্রেষ্ঠ লেখক ছিলেন। তাঁর নৈতিক উপদেশপূর্ণ সুন্দর সুললিত কবিতাবলী সাময়িক শিশু পত্রিকায় প্রকাশিত হত। তাঁর রচনার বৈশিষ্ট্য এই ছিল যে, ইসলামের ইতিহাস ও সভ্যতার কথাই তাতে বেশির ভাগ প্রকাশিত হত।

এছাড়া , ইব্রাহীম খাঁ, হাবিবুল্লাহ বাহার, শামসুন্নাহার মাহমুদ, শওকত ওসমান, এস. ওয়াজেদ আলী, মোঃ ওয়াজেদ আলী, মোহাম্মদ মোদাব্বের, মোঃ নাসির আলী, আকবর আলী, খান মঈন উদ্দিন, ফরুখ আহমদ, আহসান হাবীব, তালিম হোসেন, হোসনেআরা, হবিবর রহমান, ফয়েজ আহমদ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশে ‘ঝঙ্কার’, ‘মিনার’, ‘হুল্লোড়’ প্রভৃতি শিশু মাসিক আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। শিশু পত্রিকায় লেখা সুনির্বাচন করা ও প্রকাশন অত্যধিক দায়িত্বপূর্ণ কাজ। শিশুদেরকে খাদ্য পরিবেশনের সময় যেমন অত্যধিক সতর্কতা অবলম্বন করা একান্ত প্রয়োজন, তেমনি তাদের মানসিক আহার অর্থাৎ শিশুসাহিত্য পরিবেশনের বেলায়ও সাবধান হওয়া উচিত।

বাংলাদেশের প্রবীণ ও নবীন শিশু সাহিত্যিকদের প্রচেষ্টায় এই দেশে শিশু সাহিত্যের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হচ্ছে। ডেনমার্কে যেমন ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসন, ইংল্যাণ্ডের ল্যুই ক্যারল, ইতালির গ্যালিলিও, রাশিয়ার ম্যার্শাক আমাদের শিশু সাহিত্যের ক্ষেত্রে তেমন কোন প্রতিভাদীপ্ত সাহিত্যিকের আবির্ভাব এখনও হয় নি। তবে এই আলোচনার আগে আমাদের কয়েকটি পত্রিকার অবদানের কথা বলা প্রয়োজন।

প্রথমেই আসে দৈনিক আজাদের শিশুদের বিভাগ ‘মুকুলের মহফিলের’ প্রসঙ্গ। ১৯৪১ সালের মুকুলের মাহফিল সম্পাদনের ভার গ্রহণ করেন কৃতী শিশু-সাহিত্যিক মোহাম্মদ মোদাচ্ছের। তাঁর সম্পাদনায় ও পরিচালনায় এই শিশু বিভাগটি কিশোর সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এর কয়েক বছর পরেই ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ পত্রিকার ‘মিতালী মজলিস’ প্রকাশিত হয় কবি আহসান হাবীব ও মোহাম্মদ নাসির আলীর সম্পাদনায়। তাঁদের প্রচেষ্টায় শিশু সাহিত্যের ভাষার বেড়ে ওঠে। খান মঈনুদ্দিন ছোটদের জন্য যুক্তাক্ষর বর্জিত ভাষায় মহানবীর কাহিনী, হযরত আদম ও বিবি হাওয়ার উপাখ্যান লিখেছেন। মোহাম্মদ নাসির আলী শিশুদের মনের মতো ভাষায় মহাপুরুষদের জীবনীগুলি বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন। তারপর রূপকথার ও গল্পের প্রসঙ্গ। আমাদের সাম্প্রতিক শিশুসাহিত্য রূপ কথার ক্ষেত্রে বেশি অগ্রসর। রূপকথাকে এই দেশের কচিকাঁচাদের উপযোগী করে মৌলিকভাবে প্রকাশ করার মধ্যে লেখকদের কৃতিত্ব আছে। আতোয়ার রহমান ‘সাঁঝের বেলার রূপকথা’য় বাংলাদেশের রূপকথাকে তুলে ধরেছেন। আহসান হাবীব লিখেছেন, ‘রত্নদ্বীপ’ ও গোলাম রহমান ‘আজব দেশে এলিস’, ‘চীনের রূপকথা’ ও ‘রুশদেশের রূপকথা’। শওকত ওসমান লিখেছেন ওরা তিনজন”, ‘ওটেন সাহেবের বাংলা’ এবং আরও অনেক রসালো মিষ্টি গল্প। সাজেদুল করিমের চিংড়ি ফড়িংয়ের জন্মদিনে ছেলেদের আনন্দরস পরিবেশন করেছেন। ইসপস ফেবলের কাঠামোকে কেন্দ্র করে সরদার জয়েনউদ্দিন নতুন আঙ্গিকে গল্প রচনা করেছেন। সরদার জয়েনউদ্দিন রূপকথা ও হাসির উপাখ্যানমূলক কিছু কিছু বই লিখেছেন। ফররুখ আহমদের হরফের ছড়া’, ‘পাখীর বাসা’, ‘নতুন লেখা’ প্রভৃতি গ্রন্থ সমাদৃত হয়েছে। কেননা তিনি কচিকাঁচাদের পছন্দসই কবিতা ও ছড়া লিখতেন। এছাড়া হোসনে আরা, সুকুমার বড় যা আসরাফ সিদ্দিকী, আসাদ চৌধুরী, হালিমা খাতুন, আলমগীর জলীল, আলী ইমাম, শওকত আলী, রাহাত খান প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।

ট্যাগঃ আমাদের শিশুসাহিত্য রচনা, আমাদের শিশুসাহিত্য প্রবন্ধ রচনা, ডাউনলোড আমাদের শিশুসাহিত্য রচনা, জেনে নিন আমাদের শিশুসাহিত্য, আমাদের শিশুসাহিত্য নিয়ে রচনা।

এগুলিও পড়তে পারেন -

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button