প্রবন্ধ রচনা

বাংলা ছোটগল্প প্রবন্ধ রচনা

Bengali Short story essay writing

ছোটগল্প হল একটি সংক্ষেপে কথা বলার প্রকার। সাধারণত এক থেকে দশ মিনিটের মধ্যের সময়ে মূল্যবান কিছু ঘটনা বা ঘটনার সমারোহ সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হয়। একটি ছোটগল্প অনেক সময় কিছু শিখতে উপযোগী বা স্বপ্নভাবে উত্তেজিত করতে পারে।

উকিপিডিয়া অনুসারে, ছোটগল্পছোট গল্প) কথাসাহিত্যের একটি বিশেষ রূপবন্ধ যা দৈর্ঘ্যে হ্রস্ব এবং একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। ছোটগল্পের আকার কী হবে সে সম্পর্কে কোন সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেই। সব ছোটগল্পই গল্প বটে কিন্তু সব গল্পই ছোটগল্প নয়। একটি কাহিনী বা গল্পকে ছোটগল্পে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য কিছু নান্দনিক ও শিল্পশর্ত পূরণ করতে হয়। ছোটগল্পের সংজ্ঞার্থ কী সে নিয়ে সাহিত্যিক বিতর্ক ব্যাপক। এককথায় বলা যায়- যা আকারে ছোট, প্রকারে গল্প তাকে ছোটগল্প বলে।

বাংলা ছোটগল্প

জীবনের খণ্ডিত রূপই ছোটগল্পের বিষয়। সামগ্রিক জীবনের রূপায়ণ বড়ো একটি পটভূমিকায় চিত্রিত হয় না যেমনটি হয় উপন্যাসের বিরাট ক্যানভাসে ও তার ব্যাপকতায়। আর এজন্যে গারিকের সচেতন হওয়া প্রয়োজন, সে সচেতনতা আঙ্গিক বিষয়বস্তু দু’টি ক্ষেত্রেই। এমন কোন অবাস্তব কথা, অবাস্তব চরিত্র থাকবে না, যা গল্পের মূল সুরটিকে কেটে দেয়; তার তালভঙ্গ হয়। এজন্য গল্পে ব্যঞ্জনা লক্ষণীয়।

উপন্যাস অপেক্ষা ছোটগল্পের ক্ষেত্রেই আমাদের সাহিত্য-ভাণ্ডার অধিকতর সমৃদ্ধ। জীবনের টুকরা টুকরা ছবি, প্রাণের একটি বিশেষ আকৃতি, তার আর্তি— অল্প কথায় অল্প সময়ে সহজে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব আর সে সম্ভাবনাই সহস্র গল্পে ফুটে উঠে নানাভাবে, নানা রকমে। সম্ভাবনার এই সহজলভ্যতা লোকের পক্ষে তার ভাবনা চিন্তার রূপাযণে উপযোগী ও অনুকূল। অবশ্য এর অর্থ এই নয় যে, উপন্যাস অপেক্ষা ছোটগল্প লেখা সহজ। মোটেই নয়।

ছোটগল্পের পুরাতন দৃষ্টান্ত আছে। যেমন জাতকের গল্প। কিন্তু সত্যিকার গল্পের স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের হাতেই ছোটগল্পের সত্যিকার উদ্ভব ও বিকাশ সাধিত হয়। তিনি তাঁর লোকোত্তর প্রতিভা বলে অজস্র ছোটগল্পে জীবনের বিচিত্র চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। পল্লীর শ্যামল শ্রী, তাঁর পোস্টমাস্টারের কথা, পিতার স্নেহাতুর আর্তি, নাগরিক জীবনের কথা বিশেষ নিপুণতার সংগে প্রকাশ করেছেন। তাঁর ‘কাবুলিওয়ালা,’ ‘নষ্টনীড়,’ ‘পোস্টমাস্টার’ প্রভৃতি অসংখ্য ছোটগল্প রয়েছে, যা বিশ্ব সাহিত্যের সম্পদ। রবীন্দ্রনাথের পর প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় (১৮৭৩-১৯৩২) ছোট ছোট হাস্য-বসোচ্ছল গল্প লিখেছেন। জীবনের লঘু ও কৌতুকের দিকেই তাঁর আকর্ষণ। বীরবল (প্রমথ চৌধুরী) ‘চারইয়ারী কথা’ ও পরশুরাম রাজশেখর বসু। ‘গড্ডালিকা’ ও ‘কজলী’ গল্পগ্রন্থে কমবেশি সার্থকতা অর্জন করেছেন।মুসলমান গল্প লেখকদের মধ্যে এস. ওয়াজেদ আলী ও আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৪) রবীন্দ্রযুগে বেশ খ্যাতি অর্জন করেন। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে আবুল মনসুর আহমদ ‘আয়না’ ও ‘ফুড কনফারেন্স-এ একক। অপূর্ব কুশলতার সঙ্গে সমাজ-জীবনের দুর্বলতা, ক্ষয়িষ্ণুতা ও ভণ্ডামির উন্মোচন তিনি ঘটিয়েছেন। এস. ওয়াজেদ আলী ইতিহাস থেকে উপাদান নিয়ে গল্প রচনায় বেশ সার্থকতা অর্জন করেন। মাশুকের দরবার’, ‘দরবেশের দোয়া তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্প-গ্রন্থ।

শরৎচন্দ্র উপন্যাসের ন্যায় গল্পেও কৃতিত্ব অর্জন করেন। পল্লীজীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার অভিব্যক্তিই তাঁর গল্পের উপজীব্য বিষয়। বাঙালী জীবনকে তিনি অসাধারণ দরদের সঙ্গে দেখেছেন ও গল্পে রূপায়িত করেছেন। মনুষ্যত্বের মর্যাদা দেওয়ার ব্যাপারে তিনি ছিলেন আপসহীন। ‘রামের সুমতি’, ‘পথ নির্দেশ’ এবং ‘বিন্দুর ছেলে’ তার সুবিখ্যাত গল্প গ্রন্থ। কাজী নজরুল ইসলাম মূলত কবি। কিন্তু অনেকগুলো গল্প তিনি লিখেছেন, যদিও তাঁর গল্পগুলোতে লিরিকের প্রাবল্য -বেশি। জীবনের অভিজ্ঞতা তাঁর প্রচুর থাকলেও গল্পে তিনি তা প্রকাশ করতে পারেননি। মাহবুবুল আলম ও আবুল ফজল ছোট গল্পে বেশ কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। মধ্যবিত্ত জীবন নিয়ে মাহবুবুল আলম অনেক সুন্দর গল্প লিখেছেন। আবুল ফজল পীরদের ভণ্ডামি ও ধর্মীয় গোঁড়ামি প্রভৃতিকে ব্যঙ্গ করে অনেকগুলো গল্প রচনা করেছেন। এরপর যাঁদের সাহিত্যিক কলাকুশলতায় বাংলা সাহিত্যের পুষ্টি সাধিত হয়েছে, তাঁরা হচ্ছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, শৈলজানন্দ, বুদ্ধদেব, অচিন্ত্য, বনফুল, তারাশঙ্কর ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। কয়লা খনির মজুর, চাষী, মুটে, ফকির, বীরাঙ্গনা ও মধ্যবিত্ত জীবন, তার ফেনায়িত প্রেম ইত্যাকার বিষয়ের প্রতি এঁদের সদম্ভ পদক্ষেপ। এঁদের মধ্যে প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্পগুলো অপরূপ মিতাচারিতা ও আংগিক সচেতনতার জ্বলন্ত উদাহরণ।

বাংলাদেশে যে সব সাহিত্যিক গল্প লিখেছেন, তাঁদের মধ্যে বিখ্যাত আবুল ফজল, মাহবুবুল আলম ও শওকত ওসমান। আবুল ফজল ও মাহবুবুল আলম এখন প্রয়াত। শওকত ওসমান এখনও লিখছেন—এর কাছে অনেকেই আরো গল্প প্রত্যাশী। এঁর গল্পে জীবনের বিশেষ করে মোল্লা-মৌলভীদের ভণ্ডামি ও কুসংস্কার অতি সুন্দরভাবে রূপায়িত হয়ে উঠেছে। মাঝি-মাল্লা নিম্নবিত্ত জীবনের তথা ছোটলোকদের জীবন নিয়ে তিনি গল্প রচনায় ব্যাপৃত। ‘জুনু আপা ও অন্যান্য গল্প’, ‘পিজরাপোল’ তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ। ‘শাহেরবানু’ খ্যাত শামসুদ্দীন আবুল কালামকে কৃষক জীবনের কারু শিল্পী বলা চলে। এরপর তিনি ‘পথ জানা নেই,’ অনেক দিনের আশা লিখেছেন। এগুলো তত বেশি সার্থকতা অর্জন করতে পারেনি। এগুলোতে বাস্তববোধ অপেক্ষা ফেনিল ভাবালুতাকে বেশি প্রশ্রয় দিয়েছেন মনে হয়। ‘জিব্রাইলের ডানা’ খ্যাত শাহেদ আলী ও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ লেখক। ডঃ আলাউদ্দিন আল-আজাদ অনেক সার্থক গল্পের লেখক। তাঁর ‘ধানকন্যা’, ‘জেগে আছি,’ ‘মৃগনাভি’ ও ‘অন্ধকার সিঁড়ি’, ‘যখন সৈকতে’ বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য সংযোজন। ‘মেঘনা’, ‘ছাতা’ ‘বৃষ্টি’ ও ‘সমতল’ এই গল্প ক’টি তাকে প্রথম শ্রেণীর গল্প লেখকের মর্যাদা দিয়েছে। জীবনের বিচিত্র দিকের প্রতি সজাগ থাকলে মধ্যবিত্ত ও কৃষকের জীবন রূপায়ণে তিনি সার্থক। অন্যান্য সজাগ লেখকদের মধ্যে সৈয়দ শামসুল হক (তাস), সাইয়িদ আতিকুল্লাহ, শহীদ সাবের (এক টুকরো মেঘ), মবিনউদ্দীন (হোসেন বাড়ির বৌ) প্রমুখ উল্লেখ্য। এঁদের অধিকাংশই রোমান্টিক কিংবা বাস্তবকে রোমান্টিসিজমের প্রলেপ দিয়ে পরিবেশন করতে এরা সিদ্ধহস্ত। প্রেমের ত্রিকোণ চিত্র বা মধ্যবিত্ত জীবনের চিত্র অঙ্কনের প্রবক্তা এঁরা। এঁদের মধ্যে গ্রামীণ জীবনের পটভূমিকার পল্লীজীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার কারুশিল্পী জয়েনউদ্দিন মোটামুটিভাবে সার্থক।

আলোচনা দীর্ঘ না করে বলা চলে বর্তমানে লেখকদের মধ্যে প্রবল চেতনাবোধ জেগেছে। বাংলা সাহিত্যে মুসলমান লেখকদের ক্রম আবির্ভাব আমাদের বুক ভরিয়ে দিচ্ছে। কম-বেশি সার্থক শিল্পী আমরা নতুনদের মধ্যে পেয়েছি। এঁদের কেউ রোমান্টিক, কেই বস্তুবাদী। কিন্তু এঁরা জীবনকে দেখেছেন তাঁদের নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী এবং সেভাবেই প্রকাশ করেছেন। ফলে, বাংলা সাহিত্য বিকশিত হয়ে উঠেছে। আমাদের সাহিত্য (বিভাগোত্তর কালে। অন্যান্য শাখায় সৃষ্টিশীল সম্ভারে পুষ্ট না হলেও গল্পের ক্ষেত্র যে পুষ্ট হয়েছে তা’ অস্বীকার করা যায় না। নতুন নতুন লেখকদের আবির্ভাব হচ্ছে, তাঁরা লিখছেন কম-বেশি। নতুন-পুরাতনের সমবায়ে রচিত ছোটগল্পের সংকলন ‘শতদল’ পুস্তকখানি বাংলাদেশের গল্পের ক্ষেত্রে প্রথম উল্লেখযোগ্য সংযোজন।

সাম্প্রতিককালের গারিকদের মধ্যে আবদুল গফ্ফার চৌধুরীর ‘কৃষ্ণপক্ষ’, ‘সম্রাটের ছবি’, ‘সুন্দর হে সুন্দর’, হুমায়ূন আহমদের ‘ছায়াসঙ্গী’, ‘অয়োময়’, ‘হুমায়ূন আহমদের শ্রেষ্ঠ গল্প’ : রাহাত খানের ‘অনিশ্চিত লোকালয়’, ‘অন্তহীন যাত্রা’, ‘ভালোমন্দর টাকা’: শওকত আলীর ‘উন্মুল বাসনা’, ‘লেলিহান সাধ’, শুন হে লখিন্দর’ : আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘বংশধর’, ‘অতন্ত্র’ : সাইদিল আতিকুল্লাহর ‘বুধবার রাতে’ ; মর্তুজা বশীরের ‘কাঁচের পাখির গান’; ইমদাদুল হক মিলনের ‘ভালবাসার গল্প’, ‘নিরনের কাল’, ‘ফুলের বাগানে সাপ’, ‘বালিকারা’ হুমায়ূন কাদিরের ‘আদিম অরণ্যে একদিন’; মিন্নাত আলীর ‘মফঃস্বল সংবাদ’, ‘যাদুঘর’ ; সর্দার জয়েনউদ্দিনের ‘নয়ন-চুলি, ‘খরস্রোত’, ‘বীরকন্ঠীর বিয়ে আহমদ মীরের ‘লাল মোডিয়া’; আনোয়ার পাশার ‘নিরুপায় হরিণী’; হাসান আজিজুল হকের ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’, ‘জীবন ঘষে আগুন’ : আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘চলো যাই পরোক্ষে’, ‘উৎসব’; রিজিয়া রহমানের ‘অগ্নি স্বাক্ষর’; সেলিনা হোসেনের খোল করতাল’ : রশীদ হায়দরের ‘নানকুর বোধি, মেঘেদের ঘরবাড়ী’; আল মাহমুদের ‘পানকৌড়ির রক্ত’; নূরুন নাহারের ‘বোবামাটি’ এবং আরো অনেকের নাম উল্লেখযোগ্য। তবুও ইতিহাসের গতিধারার পরিচ্ছন্ন বিশ্লেষণে মনে হয় আমাদের সাহিত্য জীবন সমুদ্রের মোহনায মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে।

এগুলিও পড়তে পারেন -

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button