Othersপ্রবন্ধ রচনা

বাংলা সাহিত্যে নাটক রচনা | Drama in Bengali literature

“বাংলা সাহিত্যে নাটক / Drama in Bengali literature” শব্দগুলি সাহিত্যের অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হলে তা বোঝায় যে সময় একটি নাটক বা ড্রামা বাংলা ভাষায় রচিত হয় এবং তার মাধ্যমে কাহিনী, চরিত্র, ও সমাজের বিভিন্ন মৌলিক বা সামাজিক সমস্যার মূল্যায়ন হয়। এটি কবিতা, উপন্যাস, ছোট গল্প, ও অন্যান্য সাহিত্যিক রচনার মধ্যে একটি শ্রেণি হিসেবে প্রকাশ করা হয়। [বাংলা সাহিত্যে নাটক রচনা | Drama in Bengali literature]

এটি একটি উদাহরণস্বরূপে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং নজরুল ইসলামের কারণে উল্লেখযোগ্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “চিত্রনাট” একটি প্রসিদ্ধ বাংলা নাটক, যা তার ভক্তি ভাবনা, নৃত্য, ও সৌহার্দে ভরপূর্ণ হয়েছে। নজরুল ইসলামের “বিদ্রোহী” একটি অন্যতম বিখ্যাত নাটক, যেটি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে লেখা হয়েছে এবং তার মাধ্যমে স্বাধীনতা আন্দোলনের আদর্শগুলি বর্ণনা করা হয়েছে। [ বাংলা সাহিত্যে নাটক রচনা | Drama in Bengali literature ]

বাংলা সাহিত্যে নাটক

পাশ্চাত্য প্রভাবের ফলেই বাংলা নাটকের উদ্ভব। এর আগে পাঁচালি কীর্তন, কথকতার মধ্যে নাটকীয় উপাদান হয়তো ছিল, কিন্তু তাকে নাটক বলা চলে না; পাশ্চাত্য দেশের বিশেষ করে ইংরেজী সাহিত্যের প্রভাব ও ইংরেজী নাটকের অনুসরণ করে বাংলা সাহিত্যে যাঁরা প্রথম নাটক রচনা করেন তাঁরা হচ্ছেন তারাচরণ, হরেন্দ্র ঘোষ ও আরো অনেকে। কিন্তু এগুলোর উৎকর্ষ খুব কম। যে নাটকটি ঊনিশ শতকে নাট্য জগতে প্রথমে আলোড়ন সৃষ্টি করে, তা’ হচ্ছে, ‘কুলীন কুলসর্বস্ব’। [ বাংলা সাহিত্যে নাটক রচনা | Drama in Bengali literature ]

রামনারায়ণ তর্করত্ন এর লেখক। কিন্তু যিনি সত্যিকার নাটক রচনার ক্ষেত্রে নতুন পথ খুলে দিলেন, তিনি হচ্ছেন মাইকেল মধুসূদন। তাঁর প্রথম নাটক “শর্মিষ্ঠা’। ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ ও ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ তাঁর সার্থক প্রহসন। সমাজ-জীবনের ভণ্ডামিকে তিনি অপরূপ বাস্তবতার সঙ্গে উপস্থাপিত করতে সমর্থ হয়েছেন। ‘পদ্মাবতী’ তাঁর মিলনান্তক নাটক, বিয়োগান্তক নাটক হচ্ছে ‘কৃষ্ণকুমারী’ যা প্রথম সার্থক ট্রাজেডি হিসাবে সুখ্যাতি লাভের অধিকারী। ‘নীল দর্পণ’ খ্যাত দীনবন্ধু মিত্র ‘জামাই বারিক’, ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’, সবার একাদশী’ প্রভৃতি রচনা করেন। কিন্তু তাঁর খ্যাতি নীল দর্পণের জন্য। এ নাটকে তিনি চাষীর উপর নীলকর কুঠিয়ালদের অত্যাচারের জঘন্য কাহিনী অপূর্ব দরদ ও ক্ষোভের সঙ্গে চিত্রিত করেছেন। [ বাংলা সাহিত্যে নাটক রচনা | Drama in Bengali literature ]

এরপর উল্লেখযোগ্য নাট্যকার গিরিশচন্দ্র, অমৃতলাল, ক্ষীরোদপ্রসাদ ও দ্বিজেন্দ্রলাল। গিরিশচন্দ্রের অসংখ্য নাটকের মধ্যে ‘প্রযু’ সার্থক। ‘সিরাজ-উদ্দৌলা’, ‘মির কাশিম’ ও ‘ছত্রপতি শিবাজী’ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। অমৃতলাল রসসৃষ্টির রাজা। তিনি সামাজিক, রাজনৈতিক, নৈতিক জীবনের এমন সমস্যা নাই যা সম্পর্কে নাটক রচনা করেননি। ‘তরুবালা’, ‘নবযৌবন’ ‘চোরের উপর বাটপাড়ি’, ‘বিবাহ বিভ্রাট’ প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। ক্ষীরোদ প্রসাদের ‘আলমগীর’ জনপ্রিয় নাটক। দ্বিজেন্দ্রলাল ঐতিহাসিক নাটক রচনায় অভূতপূর্ব কৃতিত্ব অর্জন করেন। ‘মেবার পতন’, ‘নূরজাহান’, ‘শাজাহান’, ‘চন্দ্রগুপ্ত”, তাঁর বিখ্যাত নাটক। এই সময়ের প্রথম মহিলা নাট্যকার হচ্ছেন ‘ঊষা’ ও ‘রামের বনবাস’ রচয়িতা কামিনী সুন্দরী দেবী। [ বাংলা সাহিত্যে নাটক রচনা | Drama in Bengali literature ]

আর প্রথম মুসলমান নাট্যকার হিসেবে যিনি সম্মানিত তিনি মীর মশাররফ হোসেন। ‘বসন্তকুমারী’, ‘জমিদার দর্পণ’, ‘এর উপায় কি তাঁর রচিত নাটক ও প্রহসন। ‘জমিদার দর্পণে’ জমিদারের অত্যাচারের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। ‘নীলদর্পণ’ ও ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’র প্রভাব থাকলেও সৃষ্টি হিসাবে ‘জমিদার দর্পণ’ তুচ্ছ নয়। আরও একজন মুসলমান নাট্যকার হচ্ছেন মুহম্মদ আব্দুল করিম। তিনি ‘জগমোহনী’ নাটক রচনা করেন। কাদের আলী মোহনী প্রেমপাশা নামে একখানা নাটক লিখে বেশ সুখ্যাতি অর্জন করেন। [ বাংলা সাহিত্যে নাটক রচনা | Drama in Bengali literature ]

এরপর রবীন্দ্রনাথ। তিনি অসংখ্য নাটকের বিশেষত সাংকেতিক নাটকের স্রষ্ঠা। তার মধ্যে ‘রাজা’, ‘অচলায়তন’, ‘ডাকঘর’, ‘রক্তকরবী’ উল্লেখযোগ্য। তাঁর নাটকে নাটকীয় সংঘাত নেই বলে যে অভিযোগ করা হয়, তা যথার্থ নয়। রবীন্দ্রনাথের নাটকের তত্ত্ব আছে কিন্তু নাটকীয় সংঘাতও রয়েছে। তবে প্রায় ক্ষেত্রে তা’ তত্ত্বপ্রধান বলে তেমন জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি। [ বাংলা সাহিত্যে নাটক রচনা | Drama in Bengali literature ]

ইব্রাহিম খান ‘কাফেলা’, ‘আনোয়ার পাশা’ ও ‘কামাল পাশা’ প্রভৃতি নাটক লিখে খ্যাতি অর্জন করেন। এ সব নাটক গঠনে শেকসপীয়ারের অনুক্ষণ। দ্বিজেন্দ্রলালের প্রভাবও রয়েছে বলে মনে হয়।

বিগত ৪০ বছরে যে সব নাট্যকারের নাটক রচিত হয়েছে তাঁদের নিয়ে আমরা অনেক আশা করতে পারি। কম-বেশি সার্থকতা এঁরা প্রায় সবাই অর্জন করেছেন। [ বাংলা সাহিত্যে নাটক রচনা | Drama in Bengali literature ]

প্রাথমিক দুর্বলতা, দোষ-ত্রুটি বাদ দিলে বেশ কয়েকটি নাটককে প্রথম শ্ৰেণীৰ নাটক হিসাবে মর্যাদা দেয়া যেতে পারে। প্রথমে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন শতকর সমান। “আমলার মামলা’, ‘মণি’, ‘শিত নাটক। ‘কাকামণি। উপভোগ্য নাটক। শ্লেষে, বিদ্রূপে ও সমাজ-জীবনের তত্ত্বামি ও ব্যবসায়ীদের অসাধুতার মর্মোদ্ঘাটনে উজ্জ্বল। সমাজের গল-দুর্নীি আদর্শহীনতা, ভণ্ডামি, মিথ্যা আদর্শ, নীতিজ্ঞানহীনতা তাঁর নাটকের উপ এছাড়া ‘বাগদাদের কবি’ ও ছোটদের জন্য ‘এতিমখানা’ নামে শওকত ওসমানের দু’টি নাটক রয়েছে। আসকার ইবনে শাইখ গ্রাম্য চারী ও জমিদারের কাহিনী তাঁর নাটকের উপজীব্য হিসাবে গ্রহণ করেছেন। ‘দুরন্ত ঢেউ’, ‘বিরোধ’, ‘পদক্ষেপ’, ‘প্রতীক্ষা’, ‘বিদ্রোহী পদ্মা’, ‘অগ্নিগিরি’, ‘রক্তপদ্মা’, ‘এপার-ওপার’, ‘অনুবর্তন’ এর প্রকাশিত নাটক। চরিত্র-সৃষ্টি ও ঘাতপ্রতিঘাতের ব্যাপারে তিনি মোটামুটি সফলতা অর্জন করেছেন। নুরুল মোমেন ‘যদি এমন হতো’, ‘রূপান্তর’ ও ‘নেমেসিসে’র স্রষ্টা আঙ্গিক সচেতন, চটুল ও সাবলীল বাগভঙ্গি তাঁর বৈশিষ্ট্য। কাহিনী হিসাবে যদিও অসাধারণ নয় ‘নেমেসিস’ তাঁর সার্থক সৃষ্টি। [ বাংলা সাহিত্যে নাটক রচনা | Drama in Bengali literature ]

রচনাশৈলীর নতুনত্বে, চরিত্র সৃষ্টি ও পরিণতির সার্থকতায় নুরুল মোমেন অনেকটা সার্থক হয়েছেন। মুনীর চৌধুরীর প্রকাশিত নাটকের মধ্যে ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’, ‘কেউ কিছু জানে না’, ‘কবর’, “চিঠি” প্রভৃতি উল্লেখের দাবি রাখে। তিনি প্রতিভাবান লেখক ছিলেন। তাঁর সংলাপ ও চরিত্র সৃষ্টিতে মৌলিকতা আছে। আলী মনসুরের পোড়াবাড়ী’, ‘বোবা মানুষ নামে দু’টি নাটক আমরা পেয়েছি। গ্রামের পটভূমিকায় এর নাটকগুলি রচিত। কাজী মুহম্মদ ইলিয়াস রচিত ‘মাগলার’ সমাজ জীবনের একটি লজ্জাজনক ঘটনার মুখোশ তুলে ধরেছে। কালোবাজার আর চোরাচালান এ নাটকের উপজীব্য। সংলাপ ও চরিত্র সৃষ্টিতে নাট্যকার মোটামুটি সার্থক। আশরাফ উজ্জামানের ‘সয়লাব’ সৈয়দ পরিবার ও মীর পরিবারের সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে লেখা। আবদুল হকের ‘অদ্বিতীয়’ বহুবিবাহের সমস্যার প্রতি আলোকপাত করেছে। [ বাংলা সাহিত্যে নাটক রচনা | Drama in Bengali literature ]

‘দ্বিগ্বিজয়ী’, ‘ব্যতিক্রম’ ও ‘এই পার্কের’ রচয়িতা ওবায়দুল হক বর্তমান সমাজ-জীবনের বাস্তব সমস্যার কথা বলেছেন। এঁদের ছাড়াও রয়েছেন ইব্রাহিম খলিল ও জসীম উদ্দীন। জসীম উদ্দীন মূলত কবি। জসীম উদ্দীনের ‘মহুয়া’ ও ‘মা’ নাটক উল্লেখযোগ্য। হাল আমলের নাট্যকারদের মধ্যে যাঁরা পারঙ্গমতা অর্জন করেছেন তাঁরা হলেন আনিস চৌধুরী (‘মানচিত্র’, ‘এ্যালবাম’), ইব্রাহীম খলিল ।স্পেন বিজয়ী মুসা’, ‘সমাধি’), আ. ন. ম. বজলুর রশীদ (‘ঝড়ের পাখি’, ‘সংযুক্ত’, ‘রূপান্তর’), ইজাব উদ্দীন আহমদ (‘কেদার রায়”, “লাইলী মজনু’), আব্দুর রহমান ‘বনভোজন’, ‘ভুবন পুরের লেখক’), সাঈদ আহমদ (‘কালবেলা’, ‘বিবাহ’, ‘তৃষ্ণায়’, ‘প্রতিদিন একদিন’), কল্যাণ মিত্র (‘শপথ’, ‘অনন্যা’, ‘শুভববাহ’, ‘সাল ফকির’), মমতাজ উদ্দিন আহমদ (‘বর্ণচোরা’, ‘হরিণ চিতা-চিল’, ‘ফলাফল নিম্নচাপ’), জিয়া হায়দার (শুভ্রা সুন্দর কল্যাণী আনন্দ’, ‘এলেবেলে’।, আব্দুল্লাহ আল মামুন। ‘সুবচন নির্বাসনে’, ‘এখন দুঃসময়’, ‘চারিদিকে যুদ্ধ’। মামুনুর রশীদ (‘ইবলিশ’, ‘খোলা দুয়ার’), প্রমুখ। বলা দরকার যে, এ-সব নাট্যকারের নাটক রচনার প্রেক্ষিত সৃষ্টি করেছে এ-দেশের সমসাময়িক জীবন ও সমাজব্যবস্থা। জীবনের নানা সমস্যা ও সমাজের নানা জটিলতা তাদের শিল্পী চেতনায় ধরা পড়েছে। টেলিভিশন ও বেতার নাটক রচনায় কোন কোন নাট্যকারের সাফল্য আমাদের রস-পিপাসু দর্শক-শ্রোতার মনোরঞ্জন করতে পেরেছে। একটা কথা উল্লেখযোগ্য যে, আমাদের দেশের সাধারণ দর্শকেরা রোমান্টিক কাহিনীমূলক নাট্যাভিনয় দেখতেই অধিকতর উৎসাহী। [ বাংলা সাহিত্যে নাটক রচনা | Drama in Bengali literature ]

পশ্চিমবঙ্গের আধুনিক নাট্যকারের মধ্যে নগেন রায়, বিধায়ক ভট্টাচার্য, ঋত্বিক ঘটক, প্রমথনাথ বিশী প্রমুখের নাম করা যেতে পারে।

গত ৪০ বছরে বাংলাদেশের নাটক প্রকৃতপক্ষে মুসলমান নাট্যকার কর্তৃক নাটক রচিত হয়েছে। সমাজ জীবনের যে বিচিত্র সমস্যা রয়েছে, যে গলদ, তানি, দুর্নীতি অহরহ দৃষ্টিগোচর হচ্ছে, কলুষিত সমাজজীবনের যে বহু বিচিত্র কাহিনী অহরহ অভিনীত হচ্ছে আমাদের নাট্যকারেরা তারই রূপ দিচ্ছেন। সমস্যা সম্বন্ধে এই সচেতনতার ফলে আমরা সমস্যাভিত্তিক নাটকই পেয়েছি। অ্যাকশন অপেক্ষা সমস্যাই হয়তো প্রাধান্য লাভ করেছে। তবু এই দোষ-ত্রুটি সত্ত্বেও বলতে পারি নাট্য সৃষ্টির ব্যাপারে আমাদের লেখকদের একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে এবং সমগ্র বাংলা নাট্য-সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের নাট্যকারদের লেখা নাটক অবশ্যই প্রশংসার দাবি করতে পারে। [ বাংলা সাহিত্যে নাটক রচনা | Drama in Bengali literature ]

এগুলিও পড়তে পারেন -

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button