বাক্য প্রকরণ, উদ্দেশ্য ও বিধেয় বিস্তারিত

অনুচ্ছেদ সমূহ
বাক্য প্রকরণঃ
ভাষার বৃহত্তম একক বাক্য। বাক্যের সাহায্যেই আমরা আমাদের মনের ভাবটিকে সম্পূর্ণ রূপে প্রকাশ করি।
যদি বলি – ” আজ তোমাদের একটি গল্প বলবো।” তবে তোমরা নিশ্চয় আমার মনের কথা বুঝে একটু নড়ে চড়ে বসবে -বলবে হ্যাঁ বলুন ,বলুন।তাই তো …। এই যে তোমারা আমার মনের কথা বুঝতে পারলে -আজ, তোমাদের, একটি, গল্প, বলবো এবং আমি [ উহ্য] –এই ছটি পদের সাহায্যে আমর মনোভাবটি প্রকাশ করলাম এবং তোমাদের বুঝতে কোনো অসুবিধা হলো না। এই ছটি সুসজ্জিত পদের সমষ্টিকে বাক্য বলে।
কতোগুলো পদ সুবিন্যস্ত হয়ে বক্তার মনোভাব সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করলে তাকে বাক্য বলে।
বাক্যে কতোগুলো পদ থাকে। শব্দের সঙ্গে বিভক্তি যুক্ত হলে তাকে পদ বলে। এই বিভক্তি যুক্ত হয়ে শব্দগুলো পরস্পর সম্পর্কিত হয়ে বাক্য গঠন করে। নয়তো বাক্য তৈরি হয় না। যেমন- আমা মা আমা অনেক আদর করে। এখানে মূল শব্দগুলো বিভক্তি ছাড়া সঠিক ক্রমে সাজানো হলেও একটির সঙ্গে আরেকটি শব্দের কোন সম্পর্ক তৈরি হয়নি। শব্দগুলোতে বিভক্তি যুক্ত করলে একটি সম্পূর্ণ বাক্য তৈরি হবে- আমার মা আমাকে অনেক আদর করে। ভাষার মূল উপকরণ বাক্য, বাক্যের মৌলিক উপাদান শব্দ। আর ভাষার মূল উপাদান ধ্বনি।
বাক্য গঠনের ত্রিসূত্র :
আলংকারিক বিশ্বনাথ কবিরাজ বলেছেন-“বাক্যং স্যাৎ যোগ্যতা – আকাঙক্ষা -আসত্তি যুক্ত পদোচ্চয়:।” -এটি শুদ্ধ ও পূর্ণাঙ্গ বাক্য গঠনের ত্রিসূত্র নামে পরিচিত ।
ভাষার বিচারে/ব্যাকরণ অনুযায়ী একটি সার্থক বাক্যের ৩টি গুণ থাকতেই হবে/আবশ্যক- আকাঙক্ষা, আসত্তি, যোগ্যতা।
আকাঙক্ষা :
বাক্যে সম্পূর্ণ একটি মনোভাব থাকতে হবে। বাক্যের ভাব বা বক্তার বক্তব্য অসম্পূর্ণ থাকলে সেটি বাক্য হবে না। যেমন- মা আমাকে অনেক… বা মা আমাকে অনেক আদর… উপরের কোন বাক্যই বক্তার মনোভাব সম্পূর্ণ প্রকাশ করছে না। দুটি বাক্য শেষ হওয়ার পরও আরো কিছু শোনার আকাঙক্ষা থেকে যাচ্ছে। সুতরাং, কোন বাক্যেরই আকাঙক্ষা গুণটি নেই। তাই কোনটিই বাক্য নয়। সম্পূর্ণ বাক্যটি হবে- মা আমাকে অনেক আদর করে। এটি শোনার পর আর কিছু শোনার আগ্রহ বাকি থাকছে না। সুতরাং এটি আকাঙক্ষা গুণ সম্পন্ন একটি সার্থক বাক্য। অর্থাৎ, শ্রোতার সম্পূর্ণ বাক্য শোনার আগ্রহ-ই আকাঙক্ষা।
এটিও পড়ুন – 10+ গুরুত্বপূর্ণ ভাবসম্প্রসারণ
আসত্তি :
বাক্যের পদগুলোকে সঠিক ক্রমে/ অর্ডারে না সাজালে সেটি বাক্য হয় না। উপরের বাক্যের পদগুলো অন্যভাবে সাজালে সেটি বাক্য নাও হতে পারে। যেমন, উপরের বাক্যকে যদি এভাবে সাজানো হয়- আমার অনেক মা আদর আমাকে করে। এখানে বাক্যের প্রকৃত অর্থ যেমন বিকৃত হয়ে গেছে, তেমনি বিকৃত অর্থও পরিষ্কার ভাবে প্রকাশিত হয়নি। সুতরাং, বাক্যের পদগুলোকেও সঠিক ক্রমানুযায়ী বিন্যস্ত করতে হবে। বাক্যের এই বিন্যাসকেই আসত্তি বলে। উপরের বাক্যটিকে সঠিক ক্রমে সাজালে হবে- আমার মা আমাকে অনেক আদর করে। এখানে বাক্যের পদগুলোর বিন্যাস বাক্যটির অর্থ সঠিক ও পরিষ্কার ভাবে প্রকাশ করছে। সুতরাং এটি আসত্তি গুণ সম্পন্ন একটি সার্থক বাক্য। অর্থাৎ, বাক্যের পদগুলোকে সঠিক ক্রমে (Order) বিন্যস্ত করে বক্তার মনোভাব সঠিক ও পরিষ্কার করে বোঝানোর কৌশলই আসত্তি গুণ।
যোগ্যতা :
বাক্যের অর্থ সঠিক ও পরিষ্কার করে বোঝাতে আকাঙক্ষা ও আসত্তি গুণ ছাড়াও আরো একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হয়। বাক্যের পদগুলো যদি পরস্পর অর্থগত ও ভাবগত দিক দিয়ে সম্পর্কিত না হয়, তাহলেও সেটি সার্থক বাক্য হয় না।
যেমন-
ক) অঙ্কিতা আগুনে সাঁতার কাটছে।
খ) সূর্য পশ্চিমদিকে উঠে ।
–আদৌ বাক্য নয়। বাক্য দুটিতে আকাঙক্ষা গুণও যেমন আছে, তেমনি এতে আসত্তি গুণও আছে। কিন্তু বাক্যটি সার্থক বাক্য নয়। কারণ, মানুষের পক্ষে আগুনে সাঁতার দেওয়া অসম্ভব, আর প্রকৃতির নিয়মে সূর্যও কখনো পশ্চিমদিকে উঠে না। সুতরাং, বাক্যের পদগুলোর মধ্যে অর্থগত এবং ভাবগত কোনই মিল নেই।
বাক্য দুটি যদি এভাবে লেখা হয়-
ক) অঙ্কিতা নদীতে সাঁতার কাটছে।
খ) সূর্য পূর্বদিকে উঠে।
তাহলে বাক্য দুটির পদগুলোর মধ্যে অর্থগত ও ভাবগত মিল পাওয়া যাচ্ছে। ফলে তারা যোগ্যতা গুণ সম্পন্ন সার্থক বাক্য। অর্থাৎ, বাক্যের শব্দগুলোর অর্থগত ও ভাবগত মিলকেই যোগ্যতা বলে।
অতএব বাক্যের সংজ্ঞা এভাবে দেওয়া চলে-
যোগ্যতা, আকাঙক্ষা ও আসত্তি শর্ত মান্য করে অর্থবোধক যে পদ সমষ্টি মনের ভাব সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করে তাকে বাক্য বলে ।
ব্যাকরণবিদগণ বিভিন্নভাবে বাক্যের সংজ্ঞা দিয়েছেন-
যেমন : ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন, যে পদ বা শব্দ-সমষ্টির দ্বারা কোনও বিষয়ে বক্তার ভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকটিত হয়, সেই পদ বা শব্দ-সমষ্টিকে বাক্য বা Sentence বলে।
এটিও পড়ুন – 1000+ এক কথায় প্রকাশ অ থেকে ঔ পর্যন্ত
জ্যোতিভূষণ চাকী বলেন, যথাযথ বিন্যস্ত শব্দসমষ্টি যদি একটি সম্পূর্ণ মনোভাব প্রকাশ করে তাকে বাক্য বলে।
ড. সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায় বলেন, পরস্পর অর্থসম্বন্ধ-বিশিষ্ট যে পদগুলোর দ্বারা একটি সম্পূর্ণ ধারণা বা বক্তব্য বা ভাব প্রকাশ পায়, সেই পদগুলোর সমষ্টিকে বাক্য বলে।
উদ্দেশ্য ও বিধেয়
প্রতিটি বাক্যে দুটি অংশ থাকে : উদ্দেশ্য ও বিধেয়।
উদ্দেশ্য :
বাক্যের যে অংশে কাউকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলা হয় তাকে উদ্দেশ্য বলে।
বিধেয় :
উদ্দেশ্য সম্বন্ধে যা বলা হয় তাকে বিধেয় বলে।
যেমন :
খোকা এখন বই পড়ছে
(উদ্দেশ্য) (বিধেয়)
বিশেষ্য বা বিশেষ্যস্থানীয় অন্যান্য পদ বা পদসমষ্টিযোগে গঠিত বাক্যাংশও বাক্যের উদ্দেশ্য হতে পারে।
যেমন :
সৎ লোকেরাই প্রকৃত সুখী – বিশেষ্যরূপে ব্যবহৃত বিশেষণ
মিথ্যা কথা বলা খুবই অন্যায় – ক্রিয়াজাত বাক্যাংশ
উদ্দেশ্যের প্রকারভেদ :
একটিমাত্র পদবিশিষ্ট কর্তৃপদকে সরল উদ্দেশ্য বলে। উদ্দেশ্যের সঙ্গে বিশেষণাদি যুক্ত থাকলে তাকে সম্প্রসারিত উদ্দেশ্য বলে।
উদ্দেশ্যের সম্প্রসারণ :
১. বিশেষণ যোগে- কুখ্যাত দস্যুদল ধরা পড়েছে।
২. সম্বন্ধ যোগে- হাসিমের ভাই এসেছে।
৩. সমার্থক বাক্যাংশ যোগে-
যারা অত্যন্ত পরিশ্রমী তারাই উন্নতি করে।
৪. অসমাপিকা ক্রিয়াবিশেষণ যোগে- চাটুকার পরিবৃত হয়েই বড় সাহেব থাকেন।
৫. বিশেষণ স্থানীয় বাক্যাংশ যোগে- যার কথা তোমরা বলে থাক তিনি এসছেন।
বিধেয়ের সম্প্রসারণ :
১. ক্রিয়া বিশেষণ যোগে- ঘোড়া দ্রুত চলে।
২. ক্রিয়া বিশেষণীয় যোগে-
জেট বিমান অতিশয় দ্রুত চলে।
৩. কারকাদি যোগে- ভুবনের ঘাটে ঘাটে ভাসিছে।
৪. ক্রিয়া বিশেষণ স্থানীয় বাক্যাংশ যোগে- তিনি যে ভাবেই হোক আসবেন।
৫. বিধেয় বিশেষণ যোগে-
ইনি আমার বিশেষ অন্তরঙ্গ বন্ধু (হন)।
উদ্দেশ্যের প্রসারক :
১ )
ক) ছেলেটি যায় ।
খ) গোয়ালা ছেলেটি যায়।
গ) বেঁটেখাঁটো গোয়ালা ছেলেটি যায়।
ঘ) নীলরঙের জামা পড়া বেঁটেখাঁটো গোয়ালা ছেলেটি যায়।
2)
ক) কমল পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে।
খ) দশম শ্রেণির ছাত্র কমল পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে।
গ) প্রণবানন্দ বিদ্যাপীঠ হাই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র কমল পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে।
ঘ) ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ পরিচালিত প্রণবানন্দ বিদ্যাপীঠ হাই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র কমল পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে।
যে সব বিশেষণ পদ প্রধান উদ্দেশ্যের পূর্বে বসে উদ্দেশ্যের পূর্ণ পরিচয় ব্যক্ত করে তাকে উদ্দেশ্যের প্রসারক বলে ।
বিধেয়ের প্রসারক :
১ )
ক) ছেলেটি যায় ।
খ) ছেলেটি রোজ যায়।
গ) ছেলেটি রোজ দুধ দিতে যায়।
ঘ) ছেলেটি রোজ সাইকেলে চেপে দুধ দিতে যায়।
ঙ) ছেলেটি রোজ সাইকেলে চেপে বাড়ি বাড়ি দুধ দিতে যায়।
2)
ক ) অমিত পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে।
খ) কমল মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে।
গ) কলম 2020 সালের মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে।
ঘ) কমল 2020 সালের মাধ্যমিক পরীক্ষায় জেলার মধ্যে প্রথম হয়েছে।
বিধেয়ের অর্থকে বিশেষ করে পরিস্ফুট করার জন্য ক্রিয়ার যে বিশেষণ ইত্যাদি থাকে তাকে বিধেয়ের প্রসারক বলে।