দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও তার সামাজিক প্রতিক্রিয়া প্রবন্ধ রচনা

অনুচ্ছেদ সমূহ
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও তার সামাজিক প্রতিক্রিয়াঃ ভারতে বেকার সমস্যা ও তার প্রতিকার রচনা 600 শব্দের মধ্যে শেয়ার করার পর ছাত্রছাত্রীদের জন্য আজ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও তার সামাজিক প্রতিক্রিয়া প্রবন্ধ রচনা শেয়ার করা হল। এই প্রবন্ধ অনুসারে আর অনুরূপ প্রবন্ধ কী কী লেখা যাবে তা হল – দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি, কারণ ও প্রতিকার ; দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি ও সাধারণ মানুষের জীবন-সমস্যা; দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধির বিষময় পরিণাম ইত্যাদি।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও তার সামাজিক প্রতিক্রিয়া
[ প্রসঙ্গসূত্র ঃ ভূমিকা ; দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পরিচিত দৃষ্টান্ত ; দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সামাজিক প্রতিক্রিয়া ; দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ : মূল্যবৃদ্ধির প্রতিকার ; উপসংহার। ]ভূমিকা
আমাদের জীবনে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের প্রাথমিক প্রয়ােজন না মেটাতে পারলে বেঁচে থাকা হয় অর্থহীন। খেয়ে-পরে সুস্থভাবে বাঁচতে পারলে তাে অন্য বিষয়ে মন দেওয়া সম্ভব। সাহিত্য, শিল্প, ধর্ম প্রভৃতির চর্চা করতে গেলেও তাে চাই অন্ন-বস্ত্র। সিদ্ধ-সাধকও বলতে দ্বিধা করেননি যে, খালি পেটে ধর্ম হয় না। আমাদের শাস্ত্রে তাই ব্রহ্মকে ‘অন্নময় বিশেষণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই অন্নময় মানুষের সত্তাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যে সব দ্রব্যের প্রয়ােজন, তাদের অভাব দেখা দিলে বেঁচে থাকাই হয় অসাধ্য। দ্রব্যমূল্য উত্তরােত্তর বেড়ে চললে এইসব দ্রব্য সাধারণ দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের পক্ষে সংগ্রহ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। জীবন হয়ে ওঠে ‘শুধু দিন যাপনের গ্লানিতে পূর্ণ।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পরিচিত দৃষ্টান্ত
প্রায় প্রতি বছরই কতকগুলি অত্যাবশ্যক জিনিসের দাম বেড়ে যায়। একটি পরিচিত দৃষ্টান্ত ভােজ্য তেলের আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধি এবং অভাব। হঠাৎ শােনা গেল, পশ্চিমবঙ্গে সরষের তেল পাওয়া যাচ্ছে না, ব্যবসায়ীরা অস্বাভাবিক দাম নিচ্ছে। সরকার কিলাে প্রতি পঁচিশ টাকা দাম বেঁধে দিলেন, কিন্তু বাজারে সেই দামে তেল পাওয়া তাে দূরের কথা, জিনিসটিই হয়ে গেল উধাও। তারপর অবশ্য সরকার বিকল্প কিছু ভােজ্য তেলের ব্যবস্থা করায় সরষের তেল বাজারে আবার মিলছে, কিন্তু কবে আবার নিরুদ্দেশের পথে পাড়ি দেবে কে জানে। হঠাৎ একদিন শােনা গেল, নুন পাওয়া যাচ্ছে না। দোকানে দোকানে ক্রেতার লাইন পড়ে গেল। কিলাে-প্রতি যে নুনের দাম ছিল চল্লিশ পয়সা, হঠাৎ তা দেড় টাকা, দুটাকা দামে বিক্রি করে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দোকানদাররা হাজার হাজার টাকা লাভ করে বসলাে। এমনি ক্রেতার লাইন মাঝে মাঝে কেরােসিনের বেলাতেও দেখা যায়। সরকার নির্ধারিত মূল্য দুটাকা আটত্রিশ পয়সার বদলে তিন টাকা, চার টাকা, পাঁচ টাকা দরেও মানুষকে কেরােসিন কিনতে হয়। এইভাবে মাঝে মাঝে চালের দামও বেড়ে যায়। বাজার থেকে চাল পাওয়া কঠিন হয়। এর ফলে সাধারণ মানুষের অন্নগত প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে।
দ্রব্য মুল্য বৃদ্ধিতে সামাজিক প্রতিক্রিয়া
উপরে মাত্র কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিয়ে দেখানাে হল অত্যাবশ্যক পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির অনিয়ন্ত্রিত প্রবণতা। কিন্তু সামাজিক জীবনে এর প্রতিক্রিয়া হয় মারাত্মক। বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষ তখন দিশেহারা হয়ে এইসব জিনিস জোগাড়ের চেষ্টা করে। ধনী লােকের গায়ে আঁচড়টিও পড়ে না, পড়ে পড়ে মার খায় দরিদ্র, মধ্যবিত্ত, অল্পবেতনভুক সরকারী ও বেসরকারী শ্রমিক ও কেরানীকুল। কিন্তু এরাই তাে সমাজের বৃহত্তর অংশ। জীবন ও জীবিকার তাড়নায় মানুষগুলি এমনিতেই উদভ্রান্ত। তার উপর এই বাড়তি উপদ্রবে পরিবার ও সমাজের শাস্তি নষ্ট হয়। দেখা দেয় অসন্তোষ, বিক্ষোভ এবং নানারকম সমাজবিরােধী ক্রিয়াকর্মের অভ্যাস। জিনিসের দাম বাড়লেও তাে হাতে টাকা নেই। সেই টাকা রােজগারের তাগিদে মানুষ বাধ্য হয় বক্রপন্থার আশ্রয় নিতে। ফলে সামাজিক কাঠামােতেই ভাঙ্গন শুরু হয়। সুতরাং দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি ব্যাপারটা শুধু জিনিসের দাম বাড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি এক বহুব্যাপক সামাজিক অবক্ষয়ের কারণ হয়ে দাড়ায়। কাজেই দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি একটি বিষাক্ত ক্রিয়াচক্র। এর প্রভাবে জনসাধারণের দুঃখ-দারিদ্র্য বেড়ে যায়, তার পরিণামে দুঃখ থেকে পরিত্রাণের জন্য নানা অস্বাস্থ্যকর প্রয়াসে তারা লিপ্ত হয় এবং সামগ্রিকভাবে সামাজিক আবহাওয়া দূষিত হয়। অধুনাতন পরিভাষায় এটিও একরকম ‘দূষণ’, আর্থ সামাজিক দূষণ।
দ্রব্যমুল্য বৃদ্ধির কারণ
অর্থনীতির জটিল হিসাবের মধ্যে না গিয়েও মূল্যবৃদ্ধির একটি বড় কারণ নির্দেশ করা সম্ভব। সেটি হল চাহিদার তুলনায় দ্রব্যের উৎপাদন ও বণ্টনের বৈষম্য। আমাদের ধনতান্ত্রিক আর্থিক কাঠামােতে সমস্ত পরিকল্পনার সুফল ভােগ করে মালিক তথা ধনিক শ্রেণী। শ্রমিক শােষণ, কৃষককে বঞ্চনা, ইচ্ছাকৃতভাবে কম জিনিস উৎপাদনের মাধ্যমে চাহিদা বাড়িয়ে তােলার একটি অশুভ প্রচেষ্টা সমস্ত ব্যবস্থার মধ্যে দেখা যায়। এতে বড়লােকের পুঁজি বাড়ে বটে, কিন্তু দরিদ্র হয় আরাে বেশি দরিদ্র। দ্বিতীয় কারণ হিসাবে জনসংখ্যার বৃদ্ধি নির্দেশ করা হয়ে থাকে। কিন্তু সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে জনশক্তিকে উৎপাদনের কাজে লাগাতে পারলে জনসংখ্যার সমস্যা অনেকটাই দূর হতে পারে। বিপ্লবােত্তর চীন তার বিরাট জনশক্তিকে এইভাবে কাজে লাগিয়ে কৃষি ও শিল্পদ্রব্য উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটিয়েছে। জনসংখ্যার বৃদ্ধিকে তারা কোনাে সমস্যা বলে গণ্য করে না। তৃতীয় কারণ, প্রতি বছর বাজেটের সময় সরকার বেশ কিছু ভােগ্যপণ্যের উপর অতিরিক্ত করের বােঝা চাপিয়ে থাকেন। আর রেল বাজেটেও প্রতি বছর যাত্রী এবং মাল পরিবহণের ভাড়া বৃদ্ধি হয়। কয়লা, কেরােসিন, পেট্রোল, ডিজেল ইত্যাদির মূল্যবৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় পরিবহণ খরচ বেড়ে যায় এবং তার ফলে জিনিসের দামও বেড়ে যায়। তাছাড়া, সরকার ঘাটতি বাজেটের ফাক পূরণের জন্য টাকা ছাপিয়ে মুদ্রাস্ফীতি ঘটান এবং এর ফলে মজুতদার ও কালােবাজারীরা জিনিসপত্র চড়াদামে বিত্রীয় করার সুযােগ লাভ করে। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়, কিন্তু দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি হ্রাস পায় না। ছঁটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা শেষ হয়ে সপ্তম যােজনার কাজ চলেছে। কিন্তু পরিকল্পিত অর্থনীতি জনস্বার্থের অনুকূল না হওয়ায় সুফল খুব সামান্যই পাওয়া গেছে। মাঝে মাঝে মূল্য সূচকের হিসাবে মহার্ঘভাতা বাড়িয়ে চাকরিজীবী লােকদের বেতন বৃদ্ধি ঘটে বটে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্যবসায়ীরা জিনিসের দাম বাড়াতে শুরু করে।
মূলাবৃদ্ধির প্রতিকার
একটি প্রতিকার হলাে সর্বত্র ক্রেতা-প্রতিরােধ আন্দোলন গড়ে তােলা। অন্যায়ভাবে কোন দ্রব্যের দাম বাড়ালে সেই দাম না দেওয়া এবং প্রয়ােজন হলে সেই জিনিস বর্জন করা। কয়েক বছর আগে দমদম অঞ্চলের ক্রেতারা বলপ্রয়ােগ করে বিক্রেতাদের দাম কমাতে বাধ্য করেছিল। এটি এখন দমদম-দাওয়াই নামে পরিচিত হয়েছে। কিন্তু এই বলপ্রয়ােগের নীতি সমর্থনযােগ্য নয় এবং এর প্রভাব খুবই সাময়িক।
সমস্যার স্থায়ী সমাধানে প্রধানত সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। সুষম পরিকল্পনার সাহায্যে উৎপাদন ও চাহিদার ভারসাম্য আনতে হবে, ব্যবসায়ীদের আকাশচুম্বী লালসাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সরকারী মজুতভাণ্ডার থেকে রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে অত্যাবশ্যক দ্রব্য স্বল্পমূল্যে সারাদেশে বিক্রয়ের চেষ্টা করতে হবে। শুধু সম্পদ ও পুঁজি বাড়ানাের চেষ্টা না করে কর্মসংস্থানের সুযােগ বৃদ্ধি করতে হবে। সরকারী রেশন ও বণ্টনব্যবস্থা এখনও আছে, কিন্তু তাকে আরাে বেশি সক্রিয় এবং বহুবিস্তৃত করতে হবে। এইভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি ও চাহিদার সমতা আনতে পারলে এই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিরও প্রতিকার স্বাভাবিকভাবেই হতে পারে।
উপসংহার
এই সমস্ত উপায় অবলম্বনের মূল উদ্দেশ্য হবে জনসাধারণের কষ্ট লাঘব করা। মানুষকে খেয়ে-পরে সুস্থভাবে বাঁচার প্রয়ােজনীয় উপকরণ সহজভাবে লাভ করতে দিতে হবে। আধুনিক কল্যাণরাষ্ট্রের প্রাথমিক কর্তব্যই হচ্ছে নাগরিকের কল্যাণের দিকে নজর দেওয়া। শুধু তাই নয়, সকল শ্রেণীর মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে জীবনধারণের মৌলিক অধিকার অর্জনের নিরন্তর প্রয়াসের শামিল হওয়ার জন্য।
এটিও পড়ুন – ১০০+ ইংরেজি প্রবন্ধ রচনা পড়ুন এখানে
ট্যাগঃ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, জেনে নিন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রচনা