পূজা পদ্ধতি

শিবপূজা পদ্ধতি, মহা শিব পূজা পদ্ধতি

শিবপূজা পদ্ধতি

দেবের দেব মহাদেব। এমন মহাশক্তিধর, অথচ অল্পে-তুষ্ট দেবতা হিন্দু দেবমণ্ডলীতে বিরল। রামপ্রসাদের গানে আছে, ‘শিব আশুতোষ মহান দাতা’। সামান্য ফুল-বেলপাতা তাঁর মাথায় দিলে তিনি যা প্রতিদান দেন, তার তুলনা ত্রিজগতে নেই। এমন যে শিব, তাঁকে পূজা করতে কে না চায়? তাছাড়া তাঁর পূজা যে কেউ করতে পারে।
যাঁরা দৈনিক কর্মব্যস্ততার মধ্যেও তাঁদের প্রিয় দেবতা শিবকে নিত্যপূজা করতে চান, কিন্তু শিবপূজার বিধান সম্পর্কে সম্যক অবগত নন, এমন আপামর জনসাধারণের জন্য সরলভাবে এই পূজাপদ্ধতি প্রণীত হল। বাচ্চা ছেলেমেয়েরা শিবের পূজা করে থাকে। কারণ, ছেলেবেলায় শিবের পূজা করা বিশেষভাবে উপকারী। আপনার বাড়িতে এমন ছেলে বা মেয়ে থাকলে, তাদের এই পদ্ধতিতে শিবপূজা করা শিখিয়ে দিতে পারেন। প্রবাসী ধর্মপ্রাণ হিন্দুরাও এই পদ্ধতি মেনে সহজেই নিত্য শিবপূজা করতে পারেন। মন্ত্রপাঠ কেউ করতে পারেন, কেউ পারেন না। তাই মন্ত্রপাঠের সমর্থরা কেমনভাবে পূজা করবেন, অসমর্থরাই বা কেমনভাবে করবেন, তাও আলাদা আলাদাভাবে বলে দেওয়া হয়েছে।

মন্ত্রপাঠ প্রসঙ্গে
———————
মন্ত্রপাঠ প্রসঙ্গে প্রথমেই মনে রাখতে হবে যে, শিব মন্ত্র বা উপচারের বশ নন। আর যাই হোক, যিনি দেবের দেব, তাঁকে আপনি মন্ত্রে ভুলিয়ে উপচার ঘুষ দিয়ে কার্যসিদ্ধি করতে পারবেন, এমন চিন্তা মনেও স্থান দেবেন না। শিব ভক্তির বশ। ভক্তের হৃদয় তাঁর আড্ডাঘর। শুধুমাত্র ভক্তিদ্বারা পূজা করলে পূজা তাতেই সিদ্ধ হয়। একথাও শাস্ত্রেও স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু আপনার অন্তরের ভক্তি আপনাকে মন্ত্রপাঠে উদ্বুদ্ধ করলে, অবশ্যই মন্ত্র পড়ে পূজা করতে পারেন। সেক্ষেত্রে মন্ত্রপাঠ শুদ্ধ উচ্চারণে হওয়া উচিৎ এবং আপনারও মন্ত্রের অর্থ জেনে তা পাঠ করা উচিত। তা না করলে মন্ত্রপাঠ বৃথা। তাই নিচে পূজাপদ্ধতি বলার আগে ক্রিয়াকর্ম ও মন্ত্রের অর্থ বা ভাবার্থও দিয়ে দেওয়া হল। মন্ত্র পড়তে না পারলে মন খারাপ করার কোনো প্রয়োজন নেই। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, মন্ত্রপাঠে অসমর্থ ব্যক্তিরাও ঈশ্বরের কৃপা পেতে পারেন। সেক্ষেত্রে তাঁদের যথাযথ ভক্তিসহকারে পূজার মূল অর্থটি হৃদয়ঙ্গম করে পূজা করতে হবে। তাঁরা কিভাবে সেই পূজা করবেন, তাও পরে বলে দেওয়া হয়েছে। তবে মনে রাখবেন, দুই পদ্ধতির মূল কথা একই।

পূজাসামগ্রী ও সাধারণ নিয়মকানুন
=========================
এই জিনিসগুলি সাজিয়ে নিয়ে পূজা করতে বসবেন —
১। একটি শিবলিঙ্গ।
২। একটি ছোটো ঘটিতে স্নান করানোর জল।
৩। একটি থালা, একটি গ্লাস ও কোশাকুশি। কোশাকুশি না থাকলে তামা বা পিতলের সাধারণ ছোটো পাত্র ব্যবহার করবেন।
৪। একটু সাদা চন্দন।
৫। একটুখানি আতপ চাল।
৬। কয়েকটি ফুল ও দুটি বেলপাতা (বেলপাতা না থাকলে দুটি তুলসীপাতা দিতে পারেন)।
৭। ধূপ, দীপ।
৮। নৈবেদ্য ও পানীয় জল (আপনার সাধ্য ও ইচ্ছামতো দেবেন। একটা বাতাসা হলেও চলবে।)
৯। প্রণামী (অন্তত একটি টাকা দেবেন। ইচ্ছা করলে বেশিও দিতে পারেন।)
১০। একটি ঘণ্টা।

উপচার সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞাতব্য হল এই যে, চন্দন, ফুল-বেলপাতা, ধূপ, দীপ ও নৈবেদ্য এই পঞ্চোপচার পূজার ক্ষেত্রে অপরিহার্য্য। কোনো একটি উপচারের অভাব ঘটলে, সেই উপচারের নাম করে একটু জল দিলেও চলবে। আপনার প্রকৃত ভক্তিই সেই অভাব পূর্ণ করবে, এই কথা জানবেন।

শিবপূজা সর্বদা উত্তরমুখে বসে করবেন এবং শিবলিঙ্গকেও উত্তরমুখী করে রাখবেন। উত্তরদিক ব্রহ্মলোকপথ। তাই পরমব্রহ্মময় শিবের পূজা সর্বদা উত্তরমুখে বসে করাই নিয়ম। শিবলিঙ্গকে তামা বা পাথরের পাত্রে বসানো হয়ে থাকে।

পূজার সাধারণ ক্রম ও সেই সব ক্রিয়াকাণ্ডের অর্থ
==================================
মন্ত্রপাঠ ও ক্রিয়াকাণ্ড অর্থ জেনে করাই উচিত। তাই পূজাপদ্ধতি-বলার আগে তার ক্রম ও ক্রিয়াকাণ্ডের ভাবার্থ বলে দেওয়া ভাল। প্রথমেই আচমন করতে হয়। দেহ ও মন শুদ্ধ না হলে ঈশ্বরপূজার অধিকার জন্মায় না। তাই পূজার সময় প্রথমেই দেহ ও মন শুদ্ধ করতে হয়। দেহ ও মন শুদ্ধ করব কিভাবে? এর উপায় বিষ্ণুস্মরণ। আচমনের মন্ত্রের অর্থটি তাই—‘ আকাশে সূর্যের মতো বিদ্যমান ঈশ্বরকে ব্রহ্মজ্ঞরা সর্বদা দর্শন করেন, আমরাও যেন তাঁর স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারি। যে বিষ্ণু সকল অপবিত্রতা দূর করেন, সেই বিষ্ণুকে স্মরণ করে আমরাও যেন দেহে ও মনে শুদ্ধ হতে পারি।’ তারপর স্বস্তিবাচন। স্বস্তিবাচন হল পূজার সাফল্য ও অপরের কল্যাণ কামনা। অপরের কল্যাণ কামনা না করলে কোনো পূজা ফলপ্রসূ হয় না। অপরের অকল্যাণ কামনা করে পূজা করলে, নিজেরই অকল্যাণ হয়। তাই পূজার আগে বিশ্বের সকলের কল্যাণ কামনা করতে হয়।
তারপর জলশুদ্ধি করতে হয়। জলশুদ্ধি আর কিছুই না, যে জলে দেবতার পূজা হয়, সেই জলে তীর্থের আবাহন। জলশুদ্ধির মন্ত্রে সূর্যমণ্ডল থেকে গঙ্গা, যমুনা, গোদাবরী, সরস্বতী, নর্মদা, সিন্ধু, কাবেরী—এই সপ্ত পবিত্র নদীদেবীকে জলে আহ্বান করে জলকে শুদ্ধ করে নেওয়া হয়। সেই জল নিজের মাথায় দিলে তীর্থস্নানের ফল হয় আর পূজাদ্রব্যের উপর দিলে সেই সব দ্রব্য শুদ্ধ হয়ে যায়। তারপরসূর্যার্ঘ্য দিতে হয়। সূর্য আমাদের প্রাণের উৎস, সে কথা আধুনিক বিজ্ঞানও মানে। তাই হিন্দুদের পূজার আগে সূর্যকে অর্ঘ্য দিয়ে প্রণাম করার নিয়ম। প্রত্যক্ষ দেবতার প্রতি এ আমাদের বিশেষ শ্রদ্ধাপ্রদর্শন। এরপর গুরুদেব, পঞ্চদেবতা, নবগ্রহ, ইন্দ্রাদি দশদিকপাল, দশমহাবিদ্যা, দশাবতার ও ইষ্টদেবতা এবং সর্বদেবদেবীর পূজা। এর মাধ্যমে অন্যান্য দেবদেবীদেরও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয়। আপনার ঠাকুরের আসনে অন্যান্য ঠাকুরদেবতার ছবি বা বিগ্রহ থাকলে, তাঁদেরও এই সময় পূজা করে নেবেন।

তারপর শিবকে স্নান করানো হয়। এখান থেকেই প্রধান পূজা শুরু। স্নানের পর শিবের ধ্যান করে প্রথমে মনে মনে ও পরে উপচারগুলি নিবেদন করে পূজা করবেন। এই সব উপচারই তো ঈশ্বরের সৃষ্ট। তবে এগুলি দিয়ে কেন ঈশ্বরের পূজা করা হয় কেন? কেনই বা এই সব উপচার দেওয়ার নিয়ম। ঈশ্বর আমাদের মালিক, আমরা তাঁর দাস। আমাদের বাড়ির কাজের লোক, নিজের বাড়ি থেকে জিনিসপত্র এনে আমাদের ঘরের কাজ করে দেয়? আমাদেরই তাকে সামগ্রী জোগাতে হয়। সেই সামগ্রী দিয়ে সে আমাদেরই সেবা করে। ঈশ্বর তেমনই জগতের সব কিছু সৃষ্টি করেছেন, সেই সৃষ্টি দিয়ে যেন আমরা তাঁর সেবা করতে পারি। যে পঞ্চোপচার পূজার কথা বলা হয়েছে, সেই পঞ্চোপচার—অর্থাৎ, গন্ধ, পুষ্প, ধূপ, দীপ ও নৈবেদ্য হল আমাদের প্রাণধারণের প্রধান অবলম্বন পৃথিবী, আকাশ, বায়ু, আগুন ও জলের প্রতীক। এই সব উপচার দেওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা মনে করি, ঈশ্বরের সৃষ্টি এই সব জিনিস আমরা ঈশ্বরের প্রসাদ রূপে গ্রহণ করছি, স্বার্থপরভাবে আপনার সুখের জন্য ভোগ করছি না। উপরন্তু স্বয়ং আমাদের এইভাবেই তাঁর পূজা করতে শিখিয়েছেন। একথাও আমাদের স্মরণে রাখতে হবে। পূজার পর জপ করা হয়। জপমাহাত্ম্য দীক্ষিত ব্যক্তিমাত্রেই জানেন, তাই তা আর বলা হল না। জপের পর প্রণাম। প্রণাম করার আগে প্রণামী দেওয়া হয়। এটিও প্রতীকী। আমাদের অর্থাগম হয় ঈশ্বরের কৃপায়, তাই অর্থের অহংকারে আমরা যেন ঈশ্বরকে না বিস্মৃত হই এবং ঈশ্বরের দেওয়া অর্থে ঈশ্বরের সেবায় কোনো কার্পণ্য না দেখাই। অন্য মতে, ঈশ্বরকে আমরা যা দিই, তাই ঈশ্বর সহস্রগুণে আমাদের ফিরিয়ে দেন। প্রণামীর টাকা নিজের কোনো কাজে ব্যবহার করবেন না। বরং গরিবদুঃখীকে দেবেন। তাতে ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’ হবে। কিন্তু এটি সকাম ভক্তদের মত। পূজার পর স্তবপাঠাদি করা হয়। এতে ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি বাড়ে। ঈশ্বরও স্তবপাঠ শুনে প্রসন্ন হন।

পূজাপদ্ধতি
—————-
প্রথমে স্নান ও গুরুনির্দেশিত উপাসনাদি সেরে আসনে বসে শিব ও দুর্গাকে প্রণাম করবেন। তারপর শ্রীগুরু ও ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করে ইষ্টমন্ত্র যথাশক্তি জপ করবেন। অদীক্ষিত ও বালকবালিকারা শুধু স্নান সেরে শিবদুর্গাকে প্রণাম করে বসবেন। পূজাস্থান আগেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ধূপদীপ জ্বালিয়ে নেবেন। তারপর নারায়ণকে মনে মনে নমস্কার করে পূজা শুরু করবেন।

মন্ত্রপাঠ সহ পূজা
————————-
হাতের তালুতে দু-এক ফোঁটা জল নিয়ে ‘ওঁ বিষ্ণু’ মন্ত্রে পান করবেন। মোট তিন বার এইভাবে জল পান করতে হবে। তারপর করজোড়ে বলবেন—
ওঁ তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সূরয়ঃ দিবীব চক্ষুরাততম্।
ওঁ অপবিত্রঃ পবিত্রো বা সর্বাবস্থাং গতোঽপি বা।
যঃ স্মরেৎ পুণ্ডরীকাক্ষং স বাহ্যাভ্যন্তরঃ শুচিঃ।।

তারপর পবিত্র বাদ্য ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে স্বস্তিবাচন করবেন—

ওঁ কর্তব্যেঽস্মিন্ শ্রীশিবপূজাকর্মণি ওঁ পূণ্যাহং ভবন্তো ব্রুবন্তু।
ওঁ পূণ্যাহং ওঁ পূণ্যাহং ওঁ পূণ্যাহং।
ওঁ কর্তব্যেঽস্মিন্ শ্রীশিবপূজাকর্মণি ওঁ স্বস্তি ভবন্তো ব্রুবন্তু।
ওঁ স্বস্তি ওঁ স্বস্তি ওঁ স্বস্তি।
ওঁ কর্তব্যেঽস্মিন্ শ্রীশিবপূজাকর্মণি ওঁ ঋদ্ধিং ভবন্তো ব্রুবন্তু।
ওঁ ঋদ্ধতাম্ ওঁ ঋদ্ধতাম্ ওঁ ঋদ্ধতাম্।
ওঁ স্বস্তি ন ইন্দ্রো বৃদ্ধশ্রবাঃ স্বস্তি নঃ পূষা বিশ্ববেদাঃ।
স্বস্তি নস্তার্ক্ষ্যো অরিষ্টনেমিঃ স্বস্তি নো বৃহস্পতির্দধাতু।
ওঁ স্বস্তি ওঁ স্বস্তি ওঁ স্বস্তি।

এরপর হাত জোড় করে বলবেন —

ওঁ সূর্যঃ সোমো যমঃ কালঃ সন্ধ্যে ভূতান্যহঃ ক্ষপা।
পবনো দিক্পতির্ভূমিরাকাশং খচরামরাঃ।
ব্রাহ্মং শাসনমাস্থায় কল্পধ্বমিহ সন্নিধিম্।।

এরপর জলশুদ্ধি করে নেবেন। জলশুদ্ধির মাধ্যমে সূর্যমণ্ডল থেকে সকল তীর্থকে জলে আহ্বান করে জলকে পবিত্র করা হয়। তারপর সেই পবিত্র জলে পূজার কাজ হয়। ঠাকুরের সামনে নিজের বাঁ হাতের কাছে কোশা রেখে তাতে জল দেবেন। সেই জলে আলতো করে ডান হাতের মধ্যমা আঙুল ঠেকিয়ে (নখ যেন না ঠেকে) বলবেন — ওঁ গঙ্গে চ যমুনে চৈব গোদাবরি সরস্বতি। নর্মদে সিন্ধু-কাবেরি জলেঽস্মিন সন্নিধিং কুরু। তারপর সেই জলে একটা সচন্দনফুল দিয়ে মনে মনে তীর্থদেবতাদের পূজা করবেন। এতে সকল তীর্থের পূজা করা হয়ে যায়। তীর্থপূজা সেরে নিয়ে সেই জল নিজের মাথায় একটু দেবেন। তারপর পূজার সকল দ্রব্যে ছিটিয়ে সব কিছু শুদ্ধ করে নেবেন। তারপর সূর্যের উদ্দ্যেশ্যে একটু জল শিবলিঙ্গে দেবেন। সূর্যকে জল দিয়ে সূর্যপ্রণাম করবেন—
ওঁ জবাকুসুমসঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম্।
ধ্বান্তারিং সর্বপাপঘ্নং প্রণতোঽস্মি দিবাকরম্।।

তারপর একে একে গণেশ, শ্রীগুরু, শিব, সূর্য, নারায়ণ, দুর্গা, নবগ্রহ, দশমহাবিদ্যা, দশাবতার, সর্বদেবদেবী ও আপনার ঠাকুরের আসনে অন্যান্য ঠাকুরদেবতা থাকলে তাঁদেরকে এবং আপনার ইষ্টদেবতাকে প্রত্যেককে একটি করে সচন্দন ফুল দিয়ে পূজা করবেন। অত ফুল না থাকলে প্রত্যেকে নামে জলশুদ্ধির জল একটু করে শিবলিঙ্গে দেবেন। শিবলিঙ্গে সব দেবদেবীর পূজা হয়, তাই কোনো দেবতার ছবি বা মূর্তি আপনার কাছে না থাকলে তাঁর বা তাঁদের পূজা শিবলিঙ্গেই করতে পারেন।

তারপর শিবঠাকুরকে স্নান করাবেন। একঘটি জল নেবেন। তাতে জলশুদ্ধির জল একটু মিশিয়ে নিতে পারেন বা জলশুদ্ধির পদ্ধতিতে সেই জলটিকেও শুদ্ধ করে নিতে পারেন। তারপর স্নানের মন্ত্রটি পড়ে বাঁ হাতে ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে স্নান করাবেন। স্নানের মন্ত্রটি হল—

ওঁ ত্র্যম্বকং যজামহে সুগন্ধিং পুষ্টিবর্ধনম্।
উর্বারুকমিব বন্ধনান্মৃত্যোর্মুক্ষীয় মাঽমৃতাৎ।।

ওঁ তৎপুরুষায় বিদ্মহে মহাদেবায় ধীমহি তন্নো রুদ্রঃ প্রচোদয়াৎ ওঁ।

স্নান করিয়ে শিবের ধ্যান করবেন (ধ্যানের মন্ত্রটি বঙ্গানুবাদ সহ শেষে দেওয়া আছে) চোখ বন্ধ করে শিবের রূপটি চিন্তা করতে করতে ধ্যানমন্ত্রটি স্মরণ করে ধ্যান করতে পারেন। মন্ত্রটি মুখস্ত না থাকলে, প্রথমে একবার পাঠ করে নিয়ে চোখ বুজে শিবের রূপ ধ্যান করবেন। এইভাবে কয়েক বার করলেই মন্ত্র মুখস্ত হয়ে যাবে, তখন আর মন্ত্রপাঠ না করলেও চলবে। ধ্যানের সময় ভাববেন, আপনি চন্দন, ফুল, বেলপাতা, ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য দিয়ে সাক্ষাৎ শিবের পূজা করছেন। শিবঠাকুরও প্রসন্ন হয়ে আপনার পূজা নিচ্ছেন।

এইভাবে কিছুক্ষণ ধ্যান করে পঞ্চোপচারে পূজা করবেন। প্রথমে একটি ফুলে চন্দন মাখিয়ে গন্ধদ্রব্য দেবেন। মন্ত্র—ওঁ নমো শিবায় এষ গন্ধঃ শিবায় নমঃ। তারপর আবার একটি সচন্দন ফুল দিয়ে বলবেন— ওঁ নমো শিবায় ইদং সচন্দনপুষ্পং শিবায় নমঃ। তারপর চন্দনমাখানো বেলপাতা নেবেন— ওঁ নমো শিবায় ইদং সচন্দনবিল্বপত্রং শিবায় নমঃ।—মন্ত্রে বেলপাতাটি শিবের মাথায় দেবেন। তারপর ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য ও জল দেবেন—ওঁ নমো শিবায় এষ ধূপঃ শিবায় নমঃ। ওঁ নমো শিবায় এষ দীপঃ শিবায় নমঃ।ওঁ নমো শিবায় ইদং সোপকরণনৈবেদ্যং শিবায় নিবেদয়ামি। ওঁ নমো শিবায় ইদং পানার্থোদকং শিবায় নমঃ। মালা থাকলে ‘ওঁ নমো শিবায় ইদং পুষ্পমাল্যং শিবায় নমঃ’ মন্ত্রে পরাবেন। তারপর সচন্দন ফুল ও বেলপাতা নিয়ে ১, ৩ বা ৫ বার নিম্নোক্ত মন্ত্রে পুষ্পাঞ্জলি দেবেন—ওঁ নমো শিবায় এষ সচন্দনপুষ্পবিল্বপত্রাঞ্জলি নমো শিবায় নমঃ। এরপর অঙ্গপূজা করতে হয়। অঙ্গপূজা হল শিবের পরিবার ও সাঙ্গোপাঙ্গোদের পূজা।—
ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে ওঁ গৌর্যৈ নমঃ। ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে ওঁ অষ্টমূর্তিভ্যো নমঃ। ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে ওঁ ব্রাহ্ম্যাদ্যাষ্টমাতৃকাভ্যো নমঃ। ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে ওঁ গণেভ্যো নমঃ। ওঁ এতে গন্ধপুষ্পে ওঁ বৃষভায় নমঃ।
এই পাঁচটি মন্ত্র পড়ে প্রত্যেকের নামে একটি করে ফুল বা একটু করে জলশুদ্ধির জল দেবেন।
তারপর আপনার গুরুমন্ত্র ১০৮ বার জপ করবেন। জপ করে হাতে একটু জল নিয়ে শিবকে দিয়ে বলবেন, এই নাও আমার জপের ফল, আমি তোমাকেই সমর্পণ করলাম।
তারপর ঠাকুরকে একটি টাকা (ইচ্ছা করলে বেশিও দিতে পারেন) প্রণাম করবেন—

নমঃ শিবায় শান্তায় কারণত্রয়হেতবে।
নিবেদয়ামি চাত্মানং গতিস্তং পরমেশ্বরম্।।

পূজার পর সময় পেলে শিবের স্তবস্তোত্রাদিও পাঠ করতে পারেন।

মন্ত্রপাঠে অসমর্থ ব্যক্তিদের জন্য
======================
প্রথমে মনে মনে বিষ্ণুকে স্মরণ করে বলবেন—‘হে ঈশ্বর, তোমাকে আকাশের সূর্যের মতো যেন দেখতে পাই। তুমি পতিতপাবন, আমার সব পাপ মার্জনা করে, আমাকে দেহ ও মনে শুদ্ধ করে তোমার পূজার উপযোগী করে নাও।’ তারপর সর্বান্তকরণে বিশ্বের সকলের কল্যাণ কামনা করবেন। তারপর গঙ্গা, যমুনা, গোদাবরী, সরস্বতী, নর্মদা, সিন্ধু ও কাবেরী—এই সাত নদীমাতাকে পাত্রের জলে আহ্বান করবেন। মনে করবেন, তাঁরা যেন সূর্যমণ্ডল থেকে নেমে এসে সেই জলে অবস্থান করলেন। তারপর একটি চন্দন-মাখানো ফুল দিতে তাঁদের পূজা করবেন। সেই জল মাথায় নেবেন, সকল পূজাদ্রব্যের উপর ছিটিয়ে দেবেন। পানের জল ছাড়া পূজার সব কাজে যেখানে জল দেওয়ার কথা আছে, সেখানে এই জলই দেবেন। তারপর কুশীতে করে একটু জল নিয়ে সূর্যের উদ্দেশ্যে দেখিয়ে শিবলিঙ্গের উপর দেবেন। সূর্যকে প্রণাম করবেন। তারপর একে একে গণেশ, শ্রীগুরু, শিব, সূর্য, নারায়ণ, দুর্গা, নবগ্রহ, দশমহাবিদ্যা, দশাবতার, সর্বদেবদেবী ও আপনার ঠাকুরের আসনে অন্যান্য ঠাকুরদেবতা থাকলে তাঁদেরকে এবং আপনার ইষ্টদেবতাকে প্রত্যেককে একটি করে সচন্দন ফুল দিয়ে পূজা করবেন। অত ফুল না থাকলে প্রত্যেকে নামে জলশুদ্ধির জল একটু করে শিবলিঙ্গে দেবেন। এবার ঘণ্টা বাজিয়ে এক ঘটি জলে শিবঠাকুরকে স্নান করাবেন। স্নানের জলে ওই সাত নদীমাতাকে আহ্বানকরা তীর্থজল একটু মিশিয়ে নেবেন। তারপর শিবের ধ্যানমন্ত্রটির বাংলা অর্থ ধরে মনে মনে তাঁর মূর্তিচিন্তা করবেন, ভাববেন তিনি আপনার হাত থেকে চন্দন, ফুল-বেলপাতা, ধূপ, দীপ ও নৈবেদ্য গ্রহণ করছেন। তারপর একে একে ‘ওঁ নমো শিবায়’ বলে বলে ওই সকল উপচার শিবলিঙ্গে দেবেন বা শিবকে দেখাবেন। মালা থাকলে পরাবেন। তারপর পুষ্পাঞ্জলি দেবেন। কোনো উপচার না থাকলে, সেই উপচারের নাম করে জল দেবেন। তারপর মা গৌরী ও শিবের সাঙ্গোপাঙ্গোদের নামে দুটি ফুল বা একটু জল দেবেন শিবলিঙ্গে। তারপর জপ করে হাতে একটু জল নিয়ে সেই জল শিবকে দিয়ে বলবেন, এই নাও আমার জপের ফল আমি তোমাকে দিলাম। তারপর ‘ওঁ নমো শিবায়’ মন্ত্রেই প্রণামী দিয়ে প্রণাম করবেন। সকল কাজই ভক্তিসহকারে করবেন। ঈশ্বর আপনার পূজা অবশ্যই গ্রহণ করবেন, এই দৃঢ় বিশ্বাস রাখবেন।

ধ্যানমন্ত্র
========
ওঁ ধ্যায়েন্নিত্যং মহেশং রজতগিরিনিভং চারুচন্দ্রাবতংসং
রত্নাকল্পোজ্জ্বলাঙ্গং পরশুমৃগবরাভীতিহস্তং প্রসন্নম্।
পদ্মাসীনং সমন্তাৎ স্তুতমমরগণৈর্ব্যাঘ্রকৃত্তিং বসানং
বিশ্বাদ্যং বিশ্ববীজং নিখিলভয়হরং পঞ্চবক্ত্রং ত্রিনেত্রম্।।

ওঁ তৎপুরুষায় বিদ্মহে মহাদেবায় ধীমহি তন্নো রুদ্রঃ প্রচোদয়াৎ ওঁ।

বাংলা অর্থ— রজতগিরির ন্যায় তাঁহার আভা, যিনি সুন্দর চন্দ্রকে ভূষণরূপে ধারণ করিয়াছেন, যাঁহার দেহ রত্নময় বেশভূষায় উজ্জ্বল, যিনি পদ্মাসনে উপবিষ্ট, আনন্দময় মূর্তি, চতুর্দিকে দেবতারা তাঁহার স্তব করিতেছেন, যিনি ব্যাঘ্রচর্ম- পরিহিত, যিনি জগতের আদি, জগতের কারণ, সকল প্রকার ভয় নাশক, পঞ্চবদন এবং প্রতিটি বদনে তিনটি চক্ষু, সেই মহেশকে নিত্য এইরূপ ধ্যান করতে হবে।
————————–————————–———————-
কৃতজ্ঞতা স্বীকার — আমার পূজ্যপাদ শ্রীশ্রীগুরুদেব। Source – Facebook

এগুলিও পড়তে পারেন -

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button